কক্সবাজারে আরসা বিরোধী রোহিঙ্গা নেতা নিহত

কামরান রেজা চৌধুরী ও জেসমিন পাপড়ি, ঢাকা। আব্দুর রহমান, কক্সবাজার
2018.06.19
উখিয়ার বালুখালি শরণার্থী শিবিরে আসা নতুন রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় নিদের্শনা দিচ্ছেন একজন স্বেচ্ছাসেবী। উখিয়ার বালুখালি শরণার্থী শিবিরে আসা নতুন রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় নিদের্শনা দিচ্ছেন একজন স্বেচ্ছাসেবী। ২১ জানুয়ারি ২০১৮।
AP

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একজন শীর্ষ নেতা নিহত হয়েছেন। আরিফ উল্লাহ (৩৫) নামের ওই রোহিঙ্গা নেতা কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালী-২ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের প্রধান নেতা (মাঝি) হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

গত সোমবার রাত ৮টার দিকে শিবিরের ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা’ আরিফ উল্লাহকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে নির্মমভাবে খুন করে বলে জানান উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের।

নিহত আরিফ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) বিরোধিতা করে আসছিলেন বলে জানিয়েছেন শিবিরের রোহিঙ্গারা। সেই বিরোধেই তিনি খুন হয়েছেন বলে তাঁদের ধারণা। বাংলাদেশের স্থানীয় প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি।

ওসি আবুল খায়ের বেনারকে জানান, “রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপ তাঁকে হত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তাঁদের ধরতে পুলিশের অভিযান চলছে।”

আরিফ উল্লাহ উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার সুবাদে আলোচিত ছিলেন। বিদেশি কোনো সংস্থার লোকজন আসলে তিনি তাঁদের কাছে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরতেন।

উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা আবুল বশর বেনারকে জানান, নিহত আরিফ উল্লাহ মিয়ানমারে কুলারবিলের ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁকে শিবিরের সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা আগেও হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। পাশাপাশি তিনি মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) বিরোধিতা করে আসছিলেন।

রোহিঙ্গা নেতা আরিফ উল্লাহ স্থানীয় প্রশাসনকে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করতেন বলে জানিয়েছেন উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী।

তিনি বেনারকে বলেন, “তাঁকে হত্যার পরিকল্পনার কথা এর আগে সামনে আসেনি। যেহেতু বিষয়টি এখন সামনে এসেছে তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।”

উখিয়া বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা নুর মোহাম্মদ বেনারকে জানান, “আশ্রয় শিবিরের রোহিঙ্গা নাগরিকদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সোচ্চার ছিলেন আরিফ উল্লাহ। তাঁর নেতৃত্বে আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিকত্বসহ নানা অধিকারের আন্দোলনে শামিল হন এবং বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন।”

গত আট মাস আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাত থেকে প্রাণে রক্ষা পেতে কক্সবাজারের আশ্রয় নিয়েছিলেন আরিফ। তাঁর বাবার নাম এখলাছ মিয়া।

রোহিঙ্গাদের দেখতে আসছেন জাতিসংঘ মহাসচিব

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যদের সফরের দুই মাসের কম সময়ের মধ্যে এবার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখতে আসছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুটারেস ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম জং কিম।

আগামী পয়লা জুলাই গুটারেস রোহিঙ্গাদের দেখতে কক্সবাজার যাচ্ছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল শাখার কর্মকর্তারা।

তিনি ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট দুদিন বাংলাদেশে অবস্থান করবেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে তাঁদের।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি চিফ অব প্রটোকল খন্দকার মাসুদুল আলম মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “জাতিসংঘ মহাসচিব আগামী পয়লা জুলাই কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলবেন। ‍তিনি ৩০ জুন অথবা পয়লা জুলাই বাংলাদেশ আসবেন। ওনার সফর সঙ্গী হিসেবে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টও বাংলাদেশে আসবেন।”

তিনি বলেন, “তাঁরা দুদিন বাংলাদেশে অবস্থান করবেন বলে আশা করা যায়।”

পর্তুগালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুটারেস জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর প্রধান ছিলেন। ইউএনএইচসিআর প্রধান হিসেবে তিনি ২০০৮ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির সফর করেন।

গত বছর আগস্টের শেষে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর জঙ্গি গোষ্ঠী আরসার আক্রমণের পর সেদেশের সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে।

প্রাণ বাঁচাতে সাড়ে সাত লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তাঁরা উখিয়া ও টেকনাফে শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সাথে প্রত্যাবাসনের জন্য গত বছর ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। তবে এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও রাখাইনে ফেরত পাঠানো যায়নি।

২৯ এপ্রিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সকল সদস্যরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখতে কক্সবাজার যান। প্রতিনিধিদলের প্রধান ঢাকা ত্যাগের আগে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা রোহিঙ্গা সমস্যা ভুলে যাবেন না। তাঁরা নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন।

শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম বেনারকে বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর একটি বড় অর্জন। মহাসচিবের সঙ্গে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রধানের কক্সবাজার সফরের কথা রয়েছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট হ‌ুমায়ূন কবির বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যে নির্যাতন হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুটারেস অবগত রয়েছেন। তিনি সব সময় তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তিনি মিয়ানমার সরকার ও মিলিটারির কঠোর সমালোচনা করেছেন।”

তিনি বলেন, “জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা একত্রে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির সফর করেছেন। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা যখন রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির সফর নিয়ে আলোচনা করবেন তখন জাতিসংঘ মহাসচিবের মতামত নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সহায়তা করবে। তাঁর মতামত আমাদের সাহায্য করবে।”

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক প্রধানের শরণার্থীশিবির সফরের মাধ্যমে এব্যাপারে ফয়সালা হতে পারে।

রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রবিহীন ও শরণার্থী: ইউএনএইচসিআর

২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবসের প্রাক্কালে মঙ্গলবার জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার ২০১৭ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা একই সাথে রাষ্ট্রবিহীন ও শরণার্থী। বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের আন্তর্জাতিক সুরক্ষা প্রয়োজন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে ১২ লাখে দাঁড়িয়েছে। রাখাইন রাজ্যে নৃশংস সামরিক অভিযান থেকে বাঁচতে তাঁরা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

আনুমানিক চার লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম এখনো রাখাইন রাজ্যে বসবাস করছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, যুদ্ধ, সহিংসতা ও দমন-পীড়নের কারণে রেকর্ড ছয় কোটি ৮৫ লাখ মানুষ সারা বিশ্বে শরণার্থী হয়েছে। যেসব রাষ্ট্রের মানুষেরা শরণার্থী হয়েছে সেসব দেশের মধ্যে রয়েছে মিয়ানমার ও সিরিয়া।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।