ইন্দোনেশিয়ার তীরে নামলেন সমুদ্রে ভাসমান রোহিঙ্গারা
2020.06.25
জাকার্তা

সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা প্রায় এক শ রোহিঙ্গাকে ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় আচেহ প্রদেশের জেলেরা বৃহস্পতিবার তীরে নিয়ে গেছেন। যদিও ওই শরণার্থীদের দেশটিতে আশ্রয় দেয়া হবে কি না সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি ইন্দোনেশিয়া।
এদিকে, রোহিঙ্গাদের ভাঙা নৌকাটি মেরামতের পর তাঁদেরকে আবারো আন্তর্জাতিক জলসীমায় পাঠিয়ে দেয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন আচেহ’র একজন কর্মকর্তা।
উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা খুবই দুর্বল ও ক্ষুধার্ত ছিলেন এবং তাঁদেরকে তীরে নিয়ে যেতে স্থানীয়রা জেলেদের সহায়তা করেন বলে বেনারকে জানান আচেহ’র কমুনিটি নেতা মোহাম্মদ হাসান।
“তখন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল, ঠাণ্ডার মধ্যে খোলা সমুদ্রে তাঁদেরকে দেখে লোকজনের খুব খারাপ লাগছিল,” বেনারকে বলেন হাসান।
হাসান জানান, স্থানীয় লোকজন রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও পোশাক সরবরাহ করেন। এদের মধ্যে একজন অসুস্থ থাকায় তাঁকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
সোমবার আচেহ’র জেলেরা সমুদ্রে ভাসমান একটি ভাঙাচোরা নৌকা থেকে ওই ৯৪ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে নিজেদের নৌকায় নিয়ে আসেন। এদের মধ্যে ১৫ শিশু, ৪৯ নারী ও ৩০ জন পুরুষ।
বৃহস্পতিবার তীরে নেবার আগে পর্যন্ত রোহিঙ্গারা উপকূল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে জেলেদের নৌকাতেই ছিলেন।
তীরে নামার পর জেলরা রোহিঙ্গাদের প্রথমে স্থানীয় মাছ বাজারের কাছে একটি আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যান। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ তাঁদেরকে সেখান থেকে উত্তর আচেহ’র ব্লাং মাংগাত জেলার পরিত্যাক্ত একটি অভিবাসন কেন্দ্রের ফাঁকা দালানে নিয়ে গেছে বলে জানান হাসান।
তিনি জানান, ওই স্থানে শরণার্থীদের থাকার মতো যথেষ্ট সুবিধা রয়েছে।
এদিকে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছাড়াতে পারে এই আশঙ্কায় স্থানীয় প্রশাসন তাঁদেরকে আবার আন্তর্জাতিক জলসীমায় পাঠিয়ে দেবার বিষয়ে মত দিয়েছে বলে বেনারকে জানান উত্তর আচেহ আঞ্চলিক প্রশাসনের সচিব রিসাওয়ান বেনতারা।
রিসাওয়ান বেনারকে বলেন, “তবে আমরা তাঁদেরকে খাদ্য ও ঔষধ সহায়তা দেবো, তাঁরা কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কি না তাও পরীক্ষা করব।”
তবে তাঁরা এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন জানিয়ে রিসাওয়ান বলেন, এর মাঝে তাঁরা রোহিঙ্গাদের ভাঙা নৌকাটি মেরামত করে দেবেন, যাতে শরণার্থীরা যেখান থেকে রওয়ানা দিয়েছিলেন সেখানে ফিরে যেতে পারেন।
রোহিঙ্গাদের সমুদ্রে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলে তাঁদের নৌকাকে পাহারা দিয়ে আন্তর্জাতিক জলসীমায় পৌঁছে দেয়া হবে বলে সাংবাদিকদের জানান স্থানীয় সেনা কমান্ডার কর্নেল সুমিরাতিং বাসকরো।
“আমরা তাঁদের নৌকাটি মেরামত করে জ্বালানি সরবরাহ করব। এর পরে বিমান ও নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ইন্দোনেশিয়ার জলসীমা থেকে ওটিকে বের করে দেবো,” সাংবাদিকদের বলেন কর্নেল বাসকরো।
তবে স্থানীয় জনগণ রোহিঙ্গাদের খাবার ও বাসস্থান সহায়তা দিতে রাজি জানিয়ে কমুনিটি নেতা হাসান রোহিঙ্গাদের সমুদ্রে ফেরত না পাঠানোর জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়ছেন।
তিনি বলেন, “স্থানীয় বাসিন্দারা আশা করে তাঁদেরকে (রোহিঙ্গাদের) সমুদ্রে পাঠানো হবে না।”
এছাড়া ওই রোহিঙ্গাদের অনেকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত থাকতে পারেন বলেও তাঁদেরকে এ অবস্থায় সমুদ্রে পাঠানোর বিরোধিতা করেছেন স্থানীয়রা।
“আমরা জেলে সম্প্রদায় তাঁদেরকে সহায়তা করতে আগ্রহী, তবে আমরা এ বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছি,” বলেন হাসান।
এদিকে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
“আমরা এখনো তথ্য সংগ্রহ করছি, এবং স্থানীয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করছি,” বেনারকে বলেন ইন্দোনেশিয় পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তেউকু ফাইজাসিয়াহ।
তবে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি এবং সরকারি কর্তৃপেক্ষর সাথে আলোচনা চলছে বলে বেনারকে জানান ইন্দোনেশিয়ায় জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা- ইউএনএইচসিআর এর মুখপাত্র মিত্রা সালিমা সুরিওনো।
রোহিঙ্গাদের সহায়তা করার জন্য স্থানীয়দের ধন্যবাদ জানিয়েছে ইন্দোনেশিয় অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে সংগঠনটির ইন্দোনেশিয় নির্বাহী পরিচালক উসমান হামিদ বলেন “রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তীরে নিয়ে আসা মানবতার এক উদর্শ উদাহরণ।”
তিনি বলেন, “এই কৃতিত্ব আচেহ’র স্থানীয় জনগণের, যারা নারী ও শিশুসহ শরণার্থীদের তীরে নিয়ে আসার ঝুঁকি নিয়েছে। তাঁরা মানবতার এক উচ্চ নিদর্শন দেখিয়েছেন।”
“কোনো অবস্থাতেই ইন্দোনেশিয়া সরকারের উচিত নয় তাঁদেরকে আবার সমুদ্রে ফেরত পাঠানো,” বলেন উসমান হামিদ।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর নিপীড়নমূলক অভিযানে ২০১৭ সালের অগাস্টের পর প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। এর আগে থেকেই আরো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা রয়েছেন বাংলাদেশে।
বর্তমানে কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে থাকা এগারো লাখের বেশি রোহিঙ্গার অনেকেই উন্নত জীবনের আশায় অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমাতে চান।
এই সমুদ্র যাত্রায় অনেকে মালয়েশিয়া পৌঁছাতে পারলেও অনেকেরই মৃত্যু হয় পথে, অনেকেই মারা যান নৌকা ডুবিতে।
বিদেশিদের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কায় সম্প্রতি মালয়েশিয়া দেশটিতে কোনো রোহিঙ্গাকে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। অনেক নৌকাকে তীরে ভিড়তে না দিয়ে আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে সাগরে।
গত পাঁচ বছরে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে পথ ভুলে কিংবা নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর কয়েক হাজার রোহিঙ্গা আটকে রয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার আচেহ উপকূলে।