জাতিসংঘের সাথে যৌথভাবে রোহিঙ্গা যাচাইকরণ শুরু
2018.06.27
ঢাকা ও কক্সবাজার

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিচয় ব্যবস্থাপনা এবং ডকুমেন্টেশনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে যাচাইকরণের কাজ শুরু করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বুধবার বেনারকে বলেন, “গত চার দিন আগে রোহিঙ্গা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। এই কাজ শেষ হতে ছয় মাসের বেশি সময় লাগতে পারে।”
তবে মিয়ানমারের সাথে চলমান রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে এই যাচাইকরণ প্রভাবিত করবে না, বরং দুটো কর্মসূচি ‘পাশাপাশি চলবে’ বলে জানিয়েছেন আবুল কালাম।
তিনি জানান, “আগের নিয়মে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। যৌথ যাচাইকরণও চলবে। সরকার যেসব ডাটাবেজ করেছিল সেগুলো ইউএনএইচসিআর দেখবে, যদি সেখানে ভুল থাকে সেগুলো সংশোধন করে প্রত্যাবাসন করা হবে।”
তবে কবে নাগাদ প্রত্যাবাসন শুরু হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কিছু না বললেও “অল্প সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কাজ শুরু করা হবে,” মন্তব্য করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে গত বছরের ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের সঙ্গে একটি সম্মতিপত্র স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। তবে এখন পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গাকেই দেশে ফেরত পাঠানো যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গা যাচাইকরণের মাধ্যমে তাঁদের পরিচয় ব্যবস্থাপনা, ডকুমেন্টেশন, সুরক্ষা, সহায়তার বিধান, জনসংখ্যা পরিসংখ্যান এবং সমাধানে ব্যবহারের জন্য একটি একত্রিত তথ্যভান্ডার (ডেটাবেইস) তৈরিতে সাহায্য করবে।
ইউএনএইচসিআর জানায়, যাচাইকরণের কাজে ইউএনএইচসিআর এবং সহযোগী সংস্থার আনুমানিক ১৫০ জন কর্মীকে কাজে লাগানো হবে এবং পাশাপাশি সরকার ও কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবকেরা থাকবেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক পূর্বে নিবন্ধনকৃত সকল শরণার্থীদের এ অনুশীলনের আওতায় আনা হবে।
কক্সবাজার জেলার ইউএনএইচসিআরের সিনিয়র পাবলিক অফিসার ক্যারলিন গ্লাক বেনারকে বলেন, “সব মিলিয়ে প্রায় তিন শত কর্মী মাঠে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এটা শেষ হতে পাঁচ থেকে ছয় মাস সময় লাগতে পারে। তবে এরও আগে শেষ করার চেষ্টা আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
প্রসঙ্গত, গত বছর ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে অভিযান শুরু হলে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা গণহত্যার শিকার হতে থাকে। এমন অবস্থায় প্রাণ বাঁচাতে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
এসব রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে গত বছরের নভেম্বরে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের স্বাক্ষরিত সম্মতিপত্রে ইউএনএইচসিআরকে অন্তর্ভুক্ত না রাখায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন সংস্থাটির মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনও।
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় ইউএনএইচসিআরের সম্পৃক্ততায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রোহিঙ্গারা।
টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা আবদুল মতলব গতকাল বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কাজে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর সম্পৃক্ত হওয়ায় আমরা খুবই খুশি। আমরা আগে থেকে এমন দাবি জানিয়ে আসছিলাম।”
“তবে সেদেশের (মিয়ানমার) সেনাবাহিনী বারবার বিশৃঙ্খল সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ফলে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি কতটুকু বাস্তবায়ন হবে সে বিষয়ে সন্দেহ কাজ করে।”
নতুন করে ডেটাবেইস
এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক ডেটাবেইস সংগ্রহ করা হলেও যৌথ যাচাইকরণে তা কাজে আসছে না। ফলে নতুন করে ডেটাবেইস তৈরি করতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম বেনারকে বলেন, “ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সংগৃহীত রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন করা হয়েছে। তবে তার মধ্যে কিছু ভুল থাকায় ইউএনএইচসিআর নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্লাস্টিকের পরিচয়পত্র তৈরির জন্য ডেটাবেইস তৈরি করছে।”
“এই পরিচয়পত্রধারী রোহিঙ্গারা ত্রাণসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাবে,” বলেন তিনি।
এদিকে ইউএনএইচসিআর মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, চোখের স্ক্যান, আঙুলের ছাপ এবং স্বতন্ত্র পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য ছবিসহ বিভিন্ন বায়োমেট্রিক তথ্য ব্যবহার করে ১২ বছরের ঊর্ধ্বে সকল শরণার্থীকে পরিচয়পত্র দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনএইচসিআরের যৌথভাবে দেওয়া অনেকটা ক্রেডিট কার্ড সম মাপের প্লাস্টিকের এই পরিচয়পত্রে জালিয়াতি-বিরোধী বিভিন্ন উপাদান আছে; যা বাংলাদেশে সুরক্ষা এবং সহযোগিতা লাভের জন্য শরণার্থীদের সাহায্য করবে।
এতে বলা হয়, এ যাচাই প্রক্রিয়াটি শরণার্থীদের পরিচয় যাচাই, তারা যে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন সেটা প্রতিষ্ঠা করা এবং স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁদের অধিকারগুলো চর্চার স্বাধীনতা দেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এই কার্ডে শরণার্থীদের আদি বাসভূমি হিসেবে মিয়ানমারের নাম উল্লেখ থাকবে বলে বুধবার এক প্রতিবেদনে জানায় বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
এ ছাড়া এই কার্ডে “যে দেশে এই ব্যক্তির জীবনের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার হুমকি রয়েছে, সেখানে তাঁকে জোর করে ফেরত পাঠানো থেকে এই ব্যক্তি সুরক্ষিত থাকবেন,” লেখা থাকবে বলে জানায় রয়টার্সের ওই প্রতিবেদন।
ইউএনএইচসিআর-এর কক্সবাজার অপারেশনের প্রধান কেভিন জে. অ্যালেন বলেন, “মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বৈধ পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য এটি একটি বড় পদক্ষেপ।”
“এটা পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে, রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব আছে, তাদের অধিকারগুলো অবশ্যই স্বীকৃত হওয়া উচিত এবং সমাধানের ভিত্তিটা রচনা করতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ,” বলেন তিনি।
শরণার্থী কমিশনার আবুল কালাম বলেন, “সহায়তার পরিকল্পনাগুলো আরও ভালোভাবে গ্রহণ করতে, সেবা কার্যক্রমে ডুপ্লিকেশন এড়াতে এবং সকল নিবন্ধিত পরিবারগুলোর প্রতি সহায়তা নিশ্চিত করতে এ কাজ সরকার এবং এজেন্সিগুলোকে সাহায্য করবে।”
“প্রত্যাবাসনের সময় মিয়ানমারে এ কার্ডটি বড় ভূমিকা রাখবে,” বলেও মনে করেন তিনি।