জাতিসংঘ মহাসচিবসহ চার বিশ্ব প্রতিনিধি রোহিঙ্গা শিবিরে যাবেন
2018.06.29
ঢাকা
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা চাক্ষুস দেখতে রোববার বাংলাদেশ সফরে আসছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুটারেস ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। আর শনিবার আসছেন জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপো গ্রান্ডি এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির প্রধান পিটার মরার।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিপ্রচার অনুবিভাগের মহাপরিচালক তারেক মোহাম্মদ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রোববার প্রথম প্রহরে ঢাকায় আসবেন। আর ইউএনএইচসিআর প্রধান ফিলিপো গ্রান্ডি এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির প্রধান পিটার মরার আসবেন ৩০ জুন।
এদিকে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার বিষয়ে সোচ্চার জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনার কর্তৃক নিযুক্ত মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ র্যাপর্টিয়ার ইয়াংহি লি শুক্রবার ঢাকা পৌঁছেছেন। ব্রিটিশ মন্ত্রী মার্ক ফিল্ডও এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছেন।
মহাপরিচালক তারেক মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, সোমবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের দেখতে যাবেন ইয়াংহি লি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সাথে তিনি সাক্ষাত করবেন।
শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম বেনারকে বলেন, “জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফরের সব প্রস্ততি শেষ হয়েছে। মহাসচিবের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রধান, ইউএনএইচসিআর প্রধান ফিলিপো গ্রান্ডি এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির প্রধান পিটার মরার কক্সবাজার সফর করবেন।”
তিনি বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিবসহ অন্যরা ২ জুলাই কক্সবাজার যাবেন। তারা কুতুপালং শরণার্থী শিবির সফর করবেন ও রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলবেন।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা দেখতে গত ২৮-২৯ এপ্রিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রদূতেরা কুতুপালং সফর করেন। তাঁরা বলেন যে, তাঁদের হাতে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের যাদুকরী সমাধান নেই। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সময়সাপেক্ষ হতে পারেও বলে তাঁরা মনে করেন।
পর্তুগালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুটারেস জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর প্রধান ছিলেন। ইউএনএইচসিআর প্রধান হিসেবে তিনি ২০০৮ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির সফর করেন।
গুটারেস রোহিঙ্গাদের ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের কঠোর সমালোচক। তিনি রোহিঙ্গাদের নায্য অধিকার নিশ্চিত করতে সবসময় সোচ্চার।
চার ভিআইপি’র সফর বাংলাদেশের কূটনৈতিক সফলতা বলে মনে করেন ঢাকার বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, এই সফর মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে সহয়তা করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা সমস্যা দুবছর আগেও কোনো আঞ্চলিক ইস্যু ছিল না। তবে, গত বছর থেকে ব্যাপকহারে রোহিঙ্গা আগমনের পর থেকে বিষটি এখন প্রায় বৈশ্বিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।”
তিনি বলেন, “জাতিসংঘ মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের রোহিঙ্গা শিবির সফর মিয়ানমারের ওপর বাড়তি কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবে। এই সফরের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব রোহিঙ্গা সমস্যা ও মিয়ানমারের ভূমিকা সম্পর্কে আরও বেশি অবগত হবে।”
ড. দেলোয়ার বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দ্বি-পক্ষীয়ভাবে সমাধান করবে। তবে এই সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। এই সফরগুলো বাংলাদেশের কূটনৈতিক চাপ বৃদ্ধিতে সহয়তা করবে।
গত বছর ২৫ আগস্ট জঙ্গি গোষ্ঠী আরসা মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর একযোগে আক্রমণ চালালে সেদেশের সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর অভিযান শুরু করে।
সামরিক বাহিনীর হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বর্তমানে তাঁরা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর ২৫ আগস্টের আগে থেকে আসা রোহিঙ্গাসহ বর্তমানে ১১ লাখের বেশি মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বি-পাক্ষিক প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর করে।
চুক্তি অনুসারে প্রত্যাবাসনের প্রথম শর্ত পরিচয় যাচাই-বাছাই করতে আট হাজার ৩২জনের একটি তালিকা মিয়ানমারকে হস্তান্তর করে বাংলাদেশ। মিয়ানমার এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়নি।
প্রত্যাবাসনে সহয়তা করতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক মাস পর দুই দেশ আলাদাভাবে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে।
বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ঘোষণা
এদিকে প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের সফরের আগে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সহায়তায় বাংলাদেশকে ৪৮০ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ কোটি ৪৮ কোটি ডলার অপরিশোধযোগ্য অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। স্থানীয় মুদ্রায় ওই অনুদানের পরিমাণ ৪ হাজার ৫৬ কোটি টাকা।
বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংকের দেওয়া ঘোষণায় বলা হয়, এ সহায়তা রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও সামাজিক সুরক্ষাজনিত চাহিদা মেটাতে ব্যবহৃত হবে।
বিশ্বব্যাংক জানায়, মোট বরাদ্দের পাঁচ কোটি ডলার (৪২২ কোটি টাকা) ব্যয় করা হবে চলমান স্বাস্থ্য সহায়তা প্রকল্পে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মাতৃত্বকালীন ও নবজাতক শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সহায়তায় এই অর্থ ব্যয় করা হবে।
এক বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্ভোগ বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংক এই সহায়তা দিচ্ছে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছামূলক ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিশ্বব্যাংক সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার আশঙ্কা, বৃষ্টিপাত, বন্যা ও ভূমিধসের কারণে রোহিঙ্গারা বর্ষা মৌসুমে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে। পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবে।
ইয়াংহি লি ঢাকায়
রোহিঙ্গাদের সমস্যা নিয়ে সরকার ও রোহিঙ্গাদের সাথে আলোচনার জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনার কর্তৃক নিযুক্ত মিয়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ র্যাপর্টিয়ার ইয়াংহি লি শুক্রবার ঢাকা পৌছেছেন।
রোহিঙ্গা সংকট সৃষ্টির পর বাংলাদেশে এটি তার দ্বিতীয় সফর। আগামী সোমবার তিনি রোহিঙ্গাদের দেখতে কক্সবাজার যাবেন বলে ঢাকায় জাতিসংঘ অফিসের এক কর্মকর্তা বেনারকে জানিয়েছেন।
তিনি কক্সবাজার থেকে ফিরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করবেন বলে জানা গেছে। আগামী ৮ জুলাই তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন।
বাংলাদেশ মানবিক সঙ্কট মোকাবিলা করছে: ব্রিটিশ মন্ত্রী
যুক্তরাজ্যের এশিয়া প্যাসিফিক বিষয়ক মন্ত্রী মার্ক ফিল্ড ও সেদেশের লিঙ্গ সমতা বিষয়ক বিশেষ দূত জোয়ানা রোপার রোহিঙ্গাদের দেখতে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন বলে যুক্তরাজ্য হাইকমিশনের এক বিবৃতিতে জানিয়েছে।
জোয়ানা রোপার কক্সবাজার শরণার্থী শিবিরে নারীদের জন্য নিরাপদ স্থান দেখবেন এবং নারী ও শিশুদের প্রয়োজন জানতে শরণার্থী, সুশীল সমাজের সদস্য, মানবিক সহায়তা প্রদানকারী কর্মীদের সাথে কথা বলবেন।
এক বিবৃতিতে মার্ক ফিল্ড বলেন, “বাংলাদেশ বিরাট একটি মানবিক সঙ্কট মোকাবিলা করছে যেটি তাদের সৃষ্ট নয়। বর্ষা মৌসুমে শরণার্থী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের সহয়তা করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত বাংলাদেশের সাথে একযোগে কাজ করা।”