কক্সবাজারে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তিন রোহিঙ্গা নিহত
2020.07.09
কক্সবাজার ও ঢাকা

কক্সবাজারের উখিয়ায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবির) সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে তিন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। বিজিবির দাবি, তিনজনই ইয়াবা ব্যবসায়ী।
বৃহস্পতিবার ভোরে এই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে বলে নিশ্চিত করেন কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদ।
তিনি বেনারকে জানান, বৃহস্পতিবার ভোরে উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের তুলাতলী জলিলের গোদা নামক সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা বাংলাদেশে ঢুকবে—গোপন সূত্রে এমন খবর পেয়ে ওই স্থানে অভিযান চালানো হয়।
“এ সময় ১০-১২ জনের একটি দলকে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে দেখে বিজিবি সদস্যরা চ্যালেঞ্জ করলে চোরাকারবারীরা বিজিবিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। আত্মরক্ষার্থে বিজিবিও পাল্টা গুলি চালায়,” বলেন আলী হায়দার আজাদ।
তিনি জানান, এই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তিন রোহিঙ্গা চোরাবারবারী নিহত হন। এছাড়া বিজিবির দুই সদস্যও আহত হন।
দুই পক্ষের গোলাগুলি থামার পর ঘটনাস্থল থেকে তিনলাখ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, দুটি দেশীয় বন্দুক ও পাঁচ রাউন্ড পাইপগানের কার্তুজ উদ্ধার করা হয় বলেও জানান বিজিবি কর্মকর্তা।
তিনি জানান, চলতি বছরে এ পর্যন্ত বিজিবির ৩৪ ব্যাটালিয়ন অভিযান চালিয়ে ১১ লাখ ৪১ হাজার ২৯৭টি ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ ও ৮৯ জনকে আটক করেছে।
বন্দুকযুদ্ধে মত্যু বেড়েছে
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৪৩ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে সারা দেশে ক্রসফায়ারে ৩৬১ জন নিহত হন। এদের মধ্যে ৪০ জন রোহিঙ্গা।
এই হিসাবে চলতি বছরের মাত্র ছয় মাসে রোহিঙ্গাদের মৃত্যুর পরিমাণ প্রায় গত বছরের সমান।
পুলিশ জানায়, ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে সারা দেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনায় চারজন নারীসহ কক্সবাজার জেলায় ২৫৮ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৯৮ জন রোহিঙ্গা।
“পৃথিবীতে এটা নজিরবিহীন যে, শরণার্থীরা একাউন্টারের শিকার হচ্ছেন। যদিও বাংলাদেশ এখনো রোহিঙ্গাদের শরণার্থী স্বীকৃতি দেয়নি,” বেনারকে বলেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গারা অপরাধে জড়িয়ে থাকলেও এনকাউন্টার কোনো সমাধান হতে পারে না। দেশীয় আইনে তাঁদের বিচার হতে পারে।”
তাঁর মতে, ‘এনকাউন্টার’ আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সিস্টেমের অংশ হয়ে গেছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
“শুধু রোহিঙ্গা নয় দেশের সাধারণ মানুষও এনকাউন্টারে মারা যাচ্ছে। এর তীব্র নিন্দা জানাই,” বলেন এই মানবাধিকার কর্মী।
তিনি বলেন, “দেশে গুম এবং এনকাউন্টারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের আইনি ফাঁক থাকায় সরকার এসব ঘটনা স্বীকারও করে না। এনকাউন্টারের ঘটনাগুলোতে অস্ত্র উদ্ধারসহ নানা গল্প তৈরি করা হয়।”
ভাসানচর থেকে রোহিঙ্গাদের সরানোর আহবান
বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ভেসে ওঠা নোয়াখালীর ভাসানচরে নিয়ে রাখা ৩৩ শিশুসহ তিন শ’র বেশি রোহিঙ্গাকে অবিলম্বে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে সরিয়ে নিতে বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের প্রতি আহবান জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
পাশাপাশি, এসব রোহিঙ্গার সুরক্ষা ও সহায়তার জন্য জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছে সংস্থাটি।
উল্লেখ্য, এ বছরের এপ্রিল এবং মে মাসে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহবানে সাড়া দিয়ে মালয়েশিয়া পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা সাগরে ভাসমান কিছু রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে ভাসানচরে আশ্রয় দেয় সরকার।
এইচআরডব্লিউ বলছে, করোনাভাইরাসের ঝুঁকি এড়াতে সাময়িকভাবে তাঁদের সেখানে পৃথকভাবে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে সেসময় বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ জানায়। কিন্তু দুই মাস পেরিয়ে গেলেও চলতি বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও ঝড়ের ঝুঁকির মধ্যেই দ্বীপটিতে এখনো সেই রোহিঙ্গারা অবস্থান করছেন।
“বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ মহামারির অজুহাতে এসব রোহিঙ্গাকে সমুদ্রের মাঝখানে আটকে রেখেছে। তাঁদের পরিবার উদ্বেগের সাথে তাঁদের শিবিরে ফেরার জন্য প্রার্থনা করছে," বিবৃতিতে বলেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরিচালক (এশিয়া) ব্র্যাড অ্যাডামস।
কক্সবাজারে ওই রোহিঙ্গাদের পরিবার সদস্যরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জানিয়েছেন, ভাসানচরে আশ্রিত তাঁদের স্বজনদের চলাচলের স্বাধীনতা, খাদ্য বা চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। এমনকি নিরাপদ খাবার পানিরও তীব্র সংকটে পড়েছেন তাঁরা।
কিছু শরণার্থী অভিযোগ করেছেন, ওই দ্বীপে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের মারধর ও তাঁদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে।
কক্সবাজারের কয়েকটি পরিবার জানিয়েছেন, শিবিরের নেতারা বলেছেন, ভাসানচরে থাকা পরিবারের সদস্যদের দেখতে চাইলে তাঁদেরকেও সেখানে গিয়ে থাকতে হবে।
তবে নোয়াখালীর জেলা প্রসাশক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খান বেনারকে বলেন, “এই মুহূর্তে ভাসানচরে ৩০৬জন রোহিঙ্গা আছেন। নৌবাহিনীর তত্বাবধানে তাঁরা সেখানে ভালো আছেন। কক্সবাজারের ঘিঞ্জি পরিবেশ সেখানে নেই।”
জাতিসংঘের কর্মীদের সেখানে যেতে না দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত ভাসানচরে যেতে চেয়ে কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মীদের তরফ থেকে কোনো আবেদন আসেনি।”
এসব রোহিঙ্গাদের ভাসানচর থেকে সরানোর বিষয়ে জেলা প্রশাসন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা পায়নি জানিয়ে খোরশেদ আলম বলেন, “তাঁদেরকে কক্সবাজারে নেওয়া হবে কি না সেটাও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে আমরা চাই কক্সবাজারে নয়, সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করাতে।”
এদিকে ভাসানচরে যাওয়ার জন্য জাতিসংঘের পক্ষ থেকে কোনো আবেদন করা হয়েছে কিনা, তা জানতে চাইলে কক্সবাজারে সহায়তা সংস্থাগুলোর সমন্বয়সংস্থা ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশান গ্রুপের (আইএসসিজি) মুখপাত্র সৈকত বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।”
“ভাসানচর সরেজমিন দেখতে যাওয়ার বিষয়টি আলাপ–আলোচনা পর্যায়ে আছে,” বলেন সৈকত বিশ্বাস।
করোনা আক্রান্ত ৫৪ রোহিঙ্গা
গত ৫ জুলাই পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মোট ৫৪জন রোহিঙ্গা আক্রান্ত ও পাঁচজন মারা গেছেন বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের চিকিৎসা সমন্বয়ক ডা. আব্দুল্লাহ তোহা।
এরপরে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আর কোনো আক্রান্ত বা মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি বলে জানান তিনি।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে নতুন করে তিন হাজার ৩৬০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই সময়ে এই রোগে মারা গেছেন ৪১ জন।
এ নিয়ে দেশে মোট করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৭৫ হাজার ৪৯৪ জনে। এ পর্যন্ত মারা গেছেন দুই হাজার ২৩৮ জন।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট এক কোটি ২১ লাখ ১৮ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন পাঁচ লাখ ৫১ হাজারের বেশি।