রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রস্তুতি দেখতে মিয়ানমার যাচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
2018.07.10
ঢাকা

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাখাইন রাজ্যে পুনর্বাসনে মিয়ানমার সরকারের প্রস্তুতি দেখতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সহসাই মিয়ানমার যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখাইন সফর করলে রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর এটিই হবে বাংলাদেশি কোনো মন্ত্রীর প্রথম রাখাইন সফর।
গত বছর রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর থেকে মিয়ানমার সরকার রাখাইনে প্রবেশাধিকার সীমিত করে। সেখানে জাতিসংঘসহ কোনো সংস্থাকে সফরের অনুমতি দেয়নি বলেই চলে।
জুনের শেষ সপ্তাহে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বেইজিং সফরের দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে রাখাইন রাজ্য সফরের ঘোষণা এলো। তবে মাহমুদ আলী কখন মিয়ানমার যাবেন তা এখনো নির্ধারিত হয়নি।
মঙ্গলবার হোটেল ওয়েস্টিনে অনুষ্ঠিত মেরিটাইম কাউন্টার টেররিজম শীর্ষক এক কর্মশালা শেষে পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়েছে কিনা, ঘরবাড়ি তৈরি হয়েছে কিনা, তাদের চলাফেরা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কী অবস্থা হবে, সেটি দেখতে তিনি সশরীরে মিয়ানমারে যাবেন।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী কবে রাখাইন যাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, “শিগগিরই যাবেন। সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়ে গেলে প্রত্যাবাসন দ্রুততার সঙ্গে শুরু হবে বলে আশা করি। বেশ কিছু নাম যাচাই-বাছাই হয়ে গেছে। আমার মনে হয়, সহসাই প্রত্যাবাসন শুরু হবে।”
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি জটিল। আমার মনে হয়, বাংলাদেশে এটি যত দ্রুততার সঙ্গে এগিয়েছে অন্য দেশে তত দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হয়নি।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের দেওয়া আট হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর তালিকা থেকে মিয়ানমার ১২ দফায় ২,১৫৪ জন রোহিঙ্গার নাম প্রত্যাবাসনের জন্য যাচাই-বাছাই করেছে।
নাম যাচাই বাছাইয়ে উত্তীর্ণ রোহিঙ্গারা ইচ্ছা করলে, মিয়ানমার ফিরে যেতে পারেন। তিনি বলেন, “আমরা আশা করি, খুব সহসাই প্রত্যাবাসন শুরু হবে।”
এদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বলছেন, তাঁরা রাখাইন ফিরে যেতে চান। তবে তাঁদের রোহিঙ্গা পরিচয়ে নাগরিকত্ব দিতে হবে।
বালুখালী শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা আব্দুল রহিম বেনারকে বলেন, “আমরা যেমন খবর পাচ্ছি ওখানে ফিরে গেলে আমাদের ক্যাম্পে বন্দী করে রাখা হবে। না খেয়ে মরতে হবে। আমাদের রোহিঙ্গা হিসাবে নাগরিকত্ব না দিলে আমরা ফিরে যাব না। জাতিসংঘ না বললে আমরা ফিরে যাব না।”
বাংলাদেশ সফর শেষে মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি রোববার বলেছেন, রাখাইনে নৃশংসতা চলছে। তাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক আলোচনা ‘একেবারেই সময়োচিত’ নয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চীন সফর
২৯ জুন বেইজিংয়ে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র সাথে মাহমুদ আলী দেখা করেন। ওই সফরেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সূচি’র অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তিন্ত চ সোয়ের সাথে সাক্ষাৎ করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার বিষয়ে আলোচনা করেন।
বেইজিংয়ে তিনি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এর সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে মাহমুদ আলী চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বাংলাদেশে অবস্থানকারী ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করেন, তাঁদের দ্রুত প্রত্যাবাসনে চীন সরকারের সক্রিয় ভূমিকা কামনা করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চীন সফরের ওপর ২৯ জুলাই দেওয়া বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবাসনে চীন বাংলাদেশকে সাহায্য করতে চায়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেন, রোহিঙ্গারা এত বেশি নির্যাতিত যে তারা রাখাইনে তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চায়। তারা ক্যাম্পে নয়, তাদের নিজস্ব গ্রামে ফিরে যেতে চায়। সেখানে ফিরে গিয়ে জীবন যাপনের নিশ্চয়তা চায়।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন ও রাখাইনে তাদের পুনর্বাসনের পরিবেশ উন্নত করতে সকল প্রকার সমর্থনের আশ্বাস প্রদান করেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ই। তিনি বলেন, চীন রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য বাসস্থান নির্মাণ ও সেখানে অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টির জন্য কাজ করবে।
গত বছর আগস্টে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসার) মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর একযোগে আক্রমণ করলে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংস সামরিক অভিযান শুরু করে।
রাখাইনে শুরু হওয়া অভিযান থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম। তাঁদের প্রত্যাবাসনের জন্য ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করে।
চুক্তি অনুযায়ী দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু করার কথা। ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ আট হাজার ৩২ জন শরণার্থীর তালিকা হস্তান্তর করে। তবে, এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি।
বিশেষ দূত ঢাকা আসছেন
জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত ক্রিস্টিন বারজেনার বৃহস্পতিবার তিন দিনের সফরে ঢাকা আসছেন। তিনি বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখতে শরণার্থীশিবির সফর করবেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান।
গত ২৮ এপ্রিল জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁকে বিশেষ দূত হিসেবে মনোনীত করার পর এটিই হবে ক্রিস্টিন বারজেনারের প্রথম বাংলাদেশ সফর। এর আগে তিনি রাখাইন সফর করেছেন।