রোহিঙ্গা শিবিরে হত্যাকাণ্ড: স্বজনদের দাবি আরসা দায়ী
2018.07.16
ঢাকা

গত দশ মাসে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে কমপক্ষে ২২ জন শরণার্থী খুন হয়েছেন। স্বজনদের দাবি, অনেক হত্যাকাণ্ডের সাথেই রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরসা জড়িত। তবে পুলিশের ভাষ্য, ‘নিজেদের মধ্যে হানাহানিই’ এইসব হত্যাকাণ্ডের কারণ।
“গত বছর আগস্টের পর থেকে রোহিঙ্গা শিবিরে নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে এ পর্যন্ত ২২ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। আমরা হত্যাকাণ্ডগুলো তদন্ত করে দেখছি,” বেনারকে বলেন কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরোজুল হক টুটুল।
তবে নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ, নিহতরা আরসা বিরোধী ছিলেন বলেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
ক্যাম্পে আরসা সদস্যরা হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে শরণার্থীদের এমন অভিযোগের ব্যাপারে টুটুল বলেন, “না। ক্যাম্পে আরসা নেই।”
প্রসঙ্গত অনেক শরণার্থী এবং মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে আরসার উপস্থিতির অভিযোগ করলেও বাংলাদেশ সরকার বরাবরই তা অস্বীকার করে এসেছে।
সর্বশেষ গত মে মাসে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশে আরসা বিদ্রোহীদের উপস্থিতিরি প্রসঙ্গ উত্থাপন করে মিয়ানমার।
ওই বৈঠকে উপস্থিত শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম সেসময় বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার প্রতিনিধি দল জঙ্গি সংগঠন আরসার বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। তারা বলেছে, তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আছে যে আরসার সদস্যরা জড়ো হয়ে মিয়ানমারে আক্রমণ চালাতে পারে। আর আমরা বলেছি, বাংলাদেশে আরসার কোনো উপস্থিতি নেই।”
তিনি বলেন, উদাহরণ হিসেবে, মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, আরসার সদস্যরা বাংলাদেশে ক্যাম্পে তাদের বিরোধী লোকদের হত্যা করছে।
“আমরা বলেছি আসলে ক্যাম্পে সংগঠিত হানাহানিগুলো হলো ব্যবসা ও অন্যান্য ছোট অপরাধমূলক বিষয়। এগুলোর কোনটিই সন্ত্রাসের বিষয় নয়,” বেনারকে বলেন আবুল কালাম।
“মিয়ানমার সরকার প্রায়ই অভিযোগ করে, ক্যাম্পে আরসা/আল ইয়াকিন তৎপর। এটা মিয়ানমার সরকারের একটি কৌশল। বাংলাদেশে আরসার উপস্থিতি প্রমাণ করতে পারলেই তারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নেয়া সামরিক ব্যবস্থাকে বৈধ করতে পারবে,” সোমবার বেনারকে বলেন পুলিশ সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ উপ-মহাপরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান।
আরসার বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ
রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ আলম বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গাদের যারা রাখাইনে দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য জনমত গড়ে তোলার কাজ করছে, আরসার সদস্যরা তাঁদেরকে হত্যা করছে।
তিনি বলেন, “আরসার কারণে আজ আমাদের এই পরিণতি। তারা রোহিঙ্গাদের পক্ষে নয়, মিয়ানমার সরকারের হয়ে কাজ করছে।”
গত ১৮ জুন হত্যাকাণ্ডের শিকার হন রোহিঙ্গা আরিফ উল্লাহ। তাঁর এক আত্মীয় নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “আরিফ উল্লাহ আরসার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। আরসার সদস্যরা ক্যাম্পের ভিতর ও আশেপাশে গড়ে উঠা দোকানগুলো থেকে চাঁদাবাজি করে অর্থ আদায় করে।”
গত ১৯ জানুয়ারি ১৮-২০ জন দর্বৃত্ত ঘরে ঢুকে রোহিঙ্গা নারী জামিলা বেগমের স্বামী মো. ইউসুফকে হত্যা করে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, “সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে সাতটার দিকে আমরা কথা বলছিলাম। এমন সময়, ১৮ থেকে ২০ জন মুখোশ পরা লোক ঘরে ঢুকে আমার স্বামীকে বলে, ‘তোকেই তো খুঁজছি। এরপর তারা আমার স্বামীর কপালে গুলি করে।”
তিনি বেনারকে বলেন, “আমার স্বামী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করত।”
২৯ জানুয়ারি কুতুপালং ক্যাম্পের নিজ ঘর থেকে অপহৃত হন সাইফ উল্লাহ ও তার সহোদর ভাই শওকত উল্লাহ। তাঁর ছোট বোন সেনওয়ারা বেগম বেনারকে বলেন, “তারা বর্মাইয়া। আমার ভাইদের তুলে নেয়ার আগে তারা বলেছে তারা আলেকিন।”
“আমরা তাদের বার্মা থেকেই চিনি। আমার ভাইয়েরা তাদের সমর্থন করত না,” বলেন সেনওয়ারা।
প্রসঙ্গত রোহিঙ্গাদের কাছে আরসা এর পুরোনো নাম আল-ইয়াকিন বা আলেকিন হিসেবেও পরিচিত।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো আরসা সদস্যকে গ্রেপ্তারের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করা হয়নি। তবে শরণার্থী শিবিরের এক রোহিঙ্গা নেতা গত এপ্রিলে বেনারকে জানান, শুধু তাঁর টিমই গত জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারিতে ১৫ জন আরসা সদস্যকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে।
গত ৯ এপ্রিল গোলাবারুদ ও একটি সাব-মেশিনগানসহ রোহিঙ্গা শাহেদকে (২৬) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শরণার্থীদের দাবি শাহেদ আরসা সদস্য। তবে “আমাদের এখানে আরসা বলে কিছু নেই,” দাবি করেন উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল খায়ের।
শাহেদ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বেনারকে বলেন, “সে এখন জেলে আছে। সে কীভাবে বুলেট পেয়েছিল সেব্যাপারে আমরা তাকে প্রশ্ন করেছিলাম। সে বলেছে, তার এক বন্ধু তাকে দিয়েছে। কিন্তু সে তার সেই বন্ধুর নাম প্রকাশ করেনি।”
প্রসঙ্গত গত বছর আগস্টের ২৫ তারিখ রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষীদের ৩০টি চৌকিতে একযোগে হামলা চালায়।
ওই হামলার প্রতিক্রিয়ায় দেশটির সেনাবাহিনী রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক নিপীড়নমূলক অভিযান শুরু করে, যাকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে অভিহিত করে জাতিসংঘ।
মিয়ানমার বাহিনীর ওই অভিযানের প্রেক্ষিতে গত আগস্টের পর প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশ আশ্রয় নেয়।
শিবিরের নিরাপত্তায় হিমশিম পুলিশ
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ।
কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরোজুল হক টুটুল বেনারকে বলেন, “বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার জন্য প্রায় এক হাজার পুলিশ নিয়োজিত রয়েছে। দশ লাখ রোহিঙ্গা যাদের কোনো কাজ নেই তাদের নিরাপত্তা ও পাহারা দিতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এটা খুবই কঠিন কাজ।”
উখিয়ার ওসি আবুল খায়ের বলেন, “ক্যাম্পে বিভিন্ন অপরাধ খুব সাধারণ ব্যাপার। উখিয়াতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাস করে। অথচ আমরা একেক শিফটে মাত্র ৪০০ জন পুলিশ দিয়ে তাদের নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছি।”
তিনি বলেন, “আমাদের পুলিশ সদস্যরা পরিত্যক্ত ভবনে থাকছে। আমরা যে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করব তাদের তো থাকার জায়গা নেই।”
খায়ের বলেন, “আমরা অনেক অপরাধের মামলা গ্রহণ করি না। দুই পক্ষকে ডেকে মিটমাট করি দিই যাতে আমাদের কাজের লোড না বাড়ে।”