মিয়ানমার সেনাপ্রধানসহ ৪ সামরিক কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.07.17
ঢাকা
190717_US_travel_ban_620.jpg বর্ষা ও ভূমিধস কবলিত উখিয়ার বালুখালি রোহিঙ্গা শিবির। ৭ জুলাই ২০১৯।
[এএফপি]

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রধানসহ চার উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে দেশটির সেনাপ্রধান মিন অং লাইং, সেনাবাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ সোয়ে উইন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থান উ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অং অং এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন না।

প্রায় দু’বছর আগে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে’ লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার জন্য দায়ী করে তাঁদের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান।

২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর থেকে রাখাইন হতে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগের মাধ্যমে লাখ লাখ সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার সময় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ সংগঠিত হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে তথ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রতিনিধিদের বাংলাদেশ সফরে আসার দিনেই মার্কিন সরকার নিষেধাজ্ঞার এই সিদ্ধান্ত জানাল।

তবে বিষয়টি নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি বাংলাদেশ।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক বেনারকে বলেন, “এ বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই।”

যদিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী কর্নেল ফারুক খান বেনারকে বলেন, “এটি খুব ছোট একটি পদক্ষেপ। তবু মার্কিন এই সিদ্ধান্তকে আমি স্বাগত জানাই।”

তিনি আরও বলেন, “রোহিঙ্গা নারীদের বিরুদ্ধে চরম নির্যাতন করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এ ধরনের অপরাধের জন্য আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন ছিল।”

ফারুক খান বলেন, “হয়তো মিয়ানমার সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মিয়ানমারকে একটি বার্তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মিয়ানমার সেটা বুঝতে পারলে সকলের জন্যই মঙ্গল। অন্যথায় হয়তো আরও বড় কোনো পদক্ষেপ নেবে মার্কিন সরকার।”

এ নিষেধাজ্ঞার মূল্য রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরাও।

বাংলাদেশে ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের প্রধান ও চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ আহমেদ বেনারকে বলেন, “হয়তো মিয়ানমারের সেনাপ্রধান এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের এই নিষেধাজ্ঞার জন্য বিশেষ কোনো অসুবিধা হবে না। কারণ তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তেমন নির্ভরশীল নয়।”

“তবে তাদের বিরুদ্ধে ঘোষিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার একটি প্রতীকী মূল্য আছে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে মার্কিন স্বীকৃতি মিলল যে, মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মারাত্মক অপরাধ করেছেন,” বলেন তিনি।

“যা মিয়ানমারকে বাড়তি চাপে ফেলবে। সেটা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য ইতিবাচক হতে পারে,” মনে করেন মুনশি ফায়েজ।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নিষ্ঠুর সামরিক অভিযানের মাধ্যমে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে মিয়ানমার। জাতিসংঘ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূলের আদর্শ উদাহরণ’ বলে আখ্যায়িত করে। দায়ী করা হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রধান ও অন্যান্য সামরিক নেতৃবৃন্দকে।

বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে, মিয়ানমার সীমান্তবর্তী কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছেন।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে পালিয়ে আসার আগে রোহিঙ্গা নারীদের তিনভাগের একভাগ মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বেনারের এক সাক্ষাৎকার ভিত্তিক প্রতিবেদনে উঠে আসে।

বেনারনিউজের বিশেষ সংবাদদাতা রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ৫৪ জন নারীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকারে এদের ১৭ জন জানান, রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর অভিযানের সময় তাঁরা ধর্ষণের শিকার হন।

ওই সময় কুতুপালাং ক্যাম্পের শরণার্থী, রাখাইন রাজ্যের মংডু উপজেলার নাইসাপ্রো গ্রামের সেতারা বেগম (২৪) জানান, রাতে খাবার খাওয়ার সময় সেনারা তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর আরও কয়েকজন নারীর সাথে তাঁকে পাহাড়ে নিয়ে “পালাক্রমে” নির্যাতন চালায়।

“বর্বর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে দুজন সেখানেই মারা যায়। ধর্ষিত হওয়ার পর আমি কোনো মতে পালিয়ে আসি।” বেনারকে জানান সেতারা বেগম।

সেতারার বর্ণনায়, “তারা কাপড় খুলে বুকে ও গায়ে কামড় দিয়েছে। ওদের যা মন চায় তাই করেছে।”

সেতারা জানান, ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরে তাঁর স্বামী তাঁকে উদ্ধার করেন। ততক্ষণে সেনারা তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। ফলে পরের কয়েক দিন পাহাড়ে পাহাড়ে পালিয়ে থেকে ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রবেশ করেন তাঁরা।

তবে, মিয়ানমার সেনাপ্রধানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চলতি নিষেধাজ্ঞাটি ২০১৭ সালের আগস্টের পর রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নির্যাতনে অভিযোগ আরোপ করা হয়েছে।

এর আগে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল মঙ মঙ সোয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র। ওই বছর রোহিঙ্গা নির্যাতন ও বিতাড়নের সময়কালে জেনারেল সোয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান ছিলেন।

এছাড়া, রোহিঙ্গা নির্যাতনে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৮ সালের আগস্টে মিয়ানমারের দুটি মিলিটারি ইউনিটসহ তিনজন সেনা ও একজন বর্ডার গার্ড কমান্ডারের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

ওই সময় মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো দাবি তোলে।

নিষেধাজ্ঞা নয়, বিচার চায় রোহিঙ্গারা

কুতুপালং ক্যাম্প-২ (পূর্ব) কমিটির সভাপতি নূর মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “আমরা বারবার বলেছি, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় মিয়ানমার মিলিটারি এবং মগরা জড়িত। যারা আমাদের ভাই-বোনদের হত্যা, ধর্ষণ করেছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, তাদের বিচার করতে হবে।”

তিনি বলেন, “শুধু মিয়ানমার মিলিটারি নেতৃত্ব নয়, মগদের মধ্যে যারা আমাদের আক্রমণ করেছে, নির্যাতন করেছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে তাদের বিচার করতে হবে। আমরা বিচার চাই।”

মিয়ানমার সেনাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম

মিয়ানমারের পূর্বের নাম উল্লেখ করে বিবৃতিতে মাইক পম্পেও বলেন, “এই ঘোষণার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম বার্মার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ব্যবস্থা ঘোষণা করল। ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনায় এই সকল কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে আমরা তাদের দায়ী করেছি।”

জাতিসংঘ সমর্থিত মানবাধিকার পরিষদের সত্যানুসন্ধান মিশনের তথ্য অনুসারে, মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং লাইং এবং আরও পাঁচ জেনারেলকে হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার দায়ে বিচার করা উচিত।

মিশনের মতে, রাখাইনে সংগঠিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী মারাত্মক অপরাধ। মিশনের প্রতিবেদন জমা দেয়ার এক বছর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করলো।

এর আগে ৪ জুলা্ই মিয়ানমারে যুদ্ধাপরাধসহ মানবতার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ সংগঠিত হয়েছে কি না সে ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারকদের আহ্বান জানান আইসিসি প্রসিকিউটর ফাতু বেনসুদা।

বাংলাদেশে আইসিসি প্রতিনিধি দল

বাংলাদেশ সফররত আইসিসি প্রতিনিধি দলটি বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেছে।

সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা আর মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের বিষয়ে বাংলাদেশের কাছ থেকে আইসিসিতে সম্ভাব্য সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এসব বৈঠকে।

এ বিষয়ে প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনার করতে আইসিসির উপ-কৌঁসুলি জেমস স্টুয়ার্টের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলটি মঙ্গলবার ঢাকায় পৌঁছায়।

দলটি আগামী শুক্র ও শনিবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলবে।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।