অক্টোবরের পর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করতে পারে আইসিসি
2019.07.18
ঢাকা

গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে আগামী অক্টোবরের পর তদন্ত শুরু করতে পারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)।
তবে ওই সময়সীমার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা কিংবা তাঁদের প্রতিনিধিদের আইসিসিতে তদন্ত শুরুর বিষয়ে মতামত দিতে হবে।
বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন আইসিসির ডেপুটি প্রসিকিউটর জেমস স্টুয়ার্ট।
গত মঙ্গলবার তাঁর নেতৃত্বে আইসিসি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসে। সফরকালে সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকের পাশাপাশি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরও পরিদর্শন করবেন তাঁরা।
আইসিসি প্রতিনিধিদলের এটা দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ সফর। এর আগে চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশ সফর করে রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলে আইসিসির প্রতিনিধিদল।
স্টুয়ার্ট বলেন, “আইসিসির কৌসুলি ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা এবং তাদের প্রতিনিধিদের বক্তব্য দেওয়ার জন্য সময় বেঁধে (২৮ অক্টোবর) দিয়েছেন। প্রাকবিচারিক আদালত রোহিঙ্গাদের বক্তব্য শুনতে আগ্রহী।”
“এসব প্রক্রিয়া শেষ হতে অক্টোবর পর্যন্ত সময় লাগবে। আমরা অক্টোবর শেষ হওয়ার পরেই তদন্ত শুরুর অনুমতি চেয়েছি। প্রাকবিচারিক আদালত নির্দেশ দেওয়ার পরপরই কাজ শুরু হবে,” বলেন তিনি।
রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের জোর করে বাংলাদেশে পাঠানোর সময় গণহত্যা আর মানবতাবিরোধী অপরাধসহ ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তের জন্য চলতি মাসের শুরুতে অনুমতি চান আইসিসির কৌঁসুলি ফেতু বেনসুদা।
গত ৪ জুলাই প্রাক বিচারিক আদালতের কাছে এই অনুমতি চাওয়ার সময় ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর থেকে এসব ঘটনা তদন্তের জন্য বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারের ৩৪টি শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা।
আইসিসির এই বিচার প্রক্রিয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার যেহেতু আইসিসির সদস্য নয়, তাই তাদের সরাসরি বিচারের মুখোমুখি করার সুযোগ নেই। তবে এই তদন্তের ইতিবাচক দিক আছে।”
“তা হলো মিয়ানমার যে অন্যায় করেছে এর মাধ্যমে তার একটা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলবে। তার উপর ভিত্তি করে জাতিসংঘ বা অন্য সংস্থাগুলোকে একটা পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করবে,” বলেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেন, “আইসিসি যে সুপারিশগুলো দেবে তাতে তাদের আন্তর্জাতিক আইনের মুখোমুখি করে বিচারের আওতায় আনার কথাও থাকবে আশা করি।”
বাংলাদেশের সাথে এমওইউ করতে চায় আইসিসি
এদিকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচার কাজ চালানোর জন্য বাংলাদেশের সাথে একটি সমঝোতা স্মারক সই করতে চায় আইসিসি।
বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেছে আইসিসির প্রতিনিধিদলটি। এক বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি সমঝোতা স্মারক সই নিয়েও আলোচনা হয় বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।
জেমস স্টুয়ার্ট জানান, মূলত রোহিঙ্গা বিতাড়নের তদন্তের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনার জন্য জন্য তাঁরা বাংলাদেশ এসেছেন।
তিনি বলেন, “এটা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমরা যেখানেই কাজ করি সেখানে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে থাকি। এটা আমাদের কাজের পরিধি ঠিক করে দেয়।”
বাংলাদেশ এ বিষয়ে সম্মত হয়েছে কিনা জানতে চাইলে আইসিসির এই ডেপুটি প্রসিকিউটর বলেন, “আপাতত এর বেশি কিছু আমি বলতে পারছি না। যৌক্তিক কারণে আমরা এই সমঝোতা স্মারক গোপন রাখতে চাই।”
সূত্র জানায়, আইসিসির তদন্ত দলের দাপ্তরিক কাজের পরিধি, দপ্তর স্থাপন, সাক্ষী সুরক্ষা, আইসিসির প্রতিনিধিদের কূটনৈতিক সুবিধা নিশ্চিতসহ বিভিন্ন বিষয় সমঝোতা স্মারকের আলোচনায় উঠে আসে।
জেমস স্টুয়ার্ট বলেন, তাঁর দপ্তর রোম সনদ অনুসরণ করে স্বাধীনভাবে এই তদন্ত চালাবে। আইসিসি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের আইনগতভাবে বিচার করে থাকে। এই বিচার প্রক্রিয়ায় আইসিসির কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেই। আমরা যেকোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকেই কাজ করে থাকি।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মিয়ানমার আইসিসির সদস্য না হলেও এই বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব। কারণ, বাংলাদেশ আইসিসির সদস্য।
বাংলাদেশের পাশাপাশি আইসিসি মিয়ানমারেও তদন্ত করবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। কিন্তু আলোচনার জন্য আমাদের দরজা খোলা আছে।”
তদন্তের সময়সীমা বিষয়ে তিনি বলেন, “এটি আসলে নির্ভর করে সহযোগিতা, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর।”
জেমস স্টুয়ার্ট বলেন, আইসিসি রোহিঙ্গা নির্যাতন তদন্ত ও বিচারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ সফররত চার সদস্যের আইসিসি প্রতিনিধি দলটি আগামী শুক্র ও শনিবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলবে।
আসিয়ানকে কঠোর হওয়ার আহ্বান
এদিকে মালয়েশিয়া সফররত জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াং হি লি বলেছেন, “মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা এখন বড় উদ্বেগের কারণ। এ পরিস্থিতি পুরো অঞ্চলকে প্রভাবিত করছে, প্রতিবেশী দেশগুলো এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
দক্ষিণ পূর্ব এশীয় দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত সংস্থা আসিয়ানকে এ জন্য কঠোর হওয়ার তাগিদ দেন জাতিসংঘের এই দূত।
লি বলেন, “বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় দেড় মিলিয়ন রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। মানব পাচার, মাদক পাচারের মতো ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।”
বিশেষ দূত এ অঞ্চলের দেশগুলোকে শক্তিশালী ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “যখন এই অঞ্চলের কোনো দেশের মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক থাকে, তখন মানবাধিকারে বিষয়টি দৃঢ়ভাবে আলোচ্য সূচিতে থাকা উচিত।”
“আমি আসিয়ান দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানাই যাতে তারা মিয়ানমারে মানবাধিকারের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয় এবং এ বিষয়টি রক্ষা করতে তাদের বাধ্য করে,” বলেন ইয়াং হি লি।