রোহিঙ্গারা হতাশ, তাঁদের পুরোনো প্রস্তাবই দিলো মিয়ানমার
2019.07.29
কক্সবাজার ও ঢাকা

বাংলাদেশ সফররত মিয়ানমার প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গাদের পুরোনো প্রস্তাবই নতুন করে দেবার ফলে হতাশা প্রকাশ করেছেন শরণার্থীরা। এদিকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তথ্য যাচাইর জন্য মিয়ানমারের কাছে প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে সফররত মিয়ানমার প্রতিনিধিদল জানিয়েছে, নাগরিকত্ব দিয়ে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরানোর আইনী সুযোগ নেই। আর রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, নাগরিকত্ব না পেলে তাঁরা মিয়ানমারে ফিরবেন না।
তবে রোহিঙ্গাদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংলাপ অব্যাহত রাখতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার।
মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের সাথে বৈঠকে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার আগের সেই পুরনো প্রস্তাবগুলোই আমাদের দিয়েছে, তাই আমরা হতাশ।”
তিনি বলেন, “আমরা বলেছি, নাগরিকত্ব দিতে হবে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং আমাদের নিজ ভিটামাটি ও ঘরবাড়ি ফিরিয়ে দিতে হবে। তাহলেই আমরা মিয়ানমারে ফিরে যাব।”
“এসব বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আমাদের জানাতে পারেনি মিয়ানমার প্রতিনিধিদল। তবে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে দেওয়া সংলাপের দাবি তারা মেনে নিয়েছেন,” যোগ করেন দিল মোহাম্মদ।
প্রত্যাবাসন শুরুর লক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের বোঝানোর জন্য গত শুক্রবার রাতে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র বিষয়ক স্থায়ী সচিব মিন্ট থোয়ে’র নেতৃত্বে বাংলাদেশে আসে ১২ সদস্যর প্রতিনিধিদল। এ দলের সাথে আসিয়ানের পাঁচ সদস্যসহ ১৭ জনের প্রতিনিধিদল শনিবার ও রবিবার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন।
রোববার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তিনদফা বৈঠক শেষে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের প্রধান মিন্ট থোয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে আমাদের প্রস্তুতির বিষয়গুলো তাঁদের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি।”
প্রত্যাবাসন বিষয়ে রোহিঙ্গাদের সাথে আলোচনা অব্যাহত রাখার বিষয়ে একমত হওয়া গেছে বলেও জানান মিন্ট থোয়ে।
রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে কিনা সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনটি আমি তাঁদের কাছে ব্যাখ্য করার চেষ্টা করেছি। মূলত এ আইনে কারও দাদা-দাদি, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি কমপক্ষে তিন প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বসবাস করলে তাঁকে আত্মীকৃত (ন্যাচারালাইজড) নাগরিকত্ব বলা হয়।”
“এ আইনে তাঁরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এমনকি একবার কোনো মা-বাবা আত্মীকৃত হিসেবে নাগরিকত্ব পেলে পরবর্তীতে তাঁদের ছেলে-মেয়েরাও আবেদন করতে পারবেন,” যোগ করেন তিনি।
মিন্ট থোয়ে বলেন, “তবে এ কথা সত্য যে, আইন অনুযায়ী তাঁরা (রোহিঙ্গারা) হয়তো পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্ব পাবেন না। কিন্তু তাঁরা আত্মীকৃত নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার রাখেন।”
মিন্ট থোয়ে বলেন, এখানে হিন্দু ও খ্রিষ্টধর্ম অনুসারীদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমরা তাঁদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই। বিশেষ করে এখানকার ৪৪০ হিন্দু পরিবারকে।
প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গারা কয়েক প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বসবাস করলেও তাঁরা দেশটির নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত নন। ১৯৮২ সালের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইন রোহিঙ্গাদের অভিবাসী বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
আত্মীকৃত নাগরিকত্বের প্রক্রিয়াটি বিদেশিদের নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়া, যা মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রস্তাব করেছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ভাষ্য, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে নিজেদেরকে মিয়ানমারে বিদেশি হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে।
তাই ফিরে যাবার পূর্বশর্ত হিসেবে, জাতিগত রোহিঙ্গা পরিচয়ের স্বীকৃতি ও মিয়ানমারের সাধারণ নাগরিকত্ব দাবি রোহিঙ্গাদের।
মিন্ট থোয়ের এই সফরটি রোহিঙ্গা শিবিরে মিয়ানমারের কোনো প্রতিনিধিদিলে দ্বিতীয় সফর। এর আগে গত বছরের এপ্রিলে মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী উইন মিয়াত আয়ে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেন। তাঁদের ফিরে যেতে বলেন। রোহিঙ্গারা তখন তাঁদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে শরণার্থী শিবিরে বিভিন্ন ধরনের বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
নতুন করে পুরোনো প্রস্তাব
মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের সাথে বৈঠকে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবি দাওয়া তুলে ধরেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস এর চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ।
মুহিব বেনারকে বলেন, “দুদিন ধরে অনেক কিছু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এ আলোচনায় ইতিবাচক ফলাফল আসবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ তারা সেই পুরনো প্রস্তাবগুলোই দিচ্ছে।”
“আমরা তাঁদের সাফ জানিয়ে দিয়েছি, নাগরিকত্বসহ অন্তত তিনটি দাবি পূরণ করা না হলে আমরা মিয়ানমারে ফিরে যাব না,” জানান মুহিব উল্লাহ।
গত শনিবার ও রোববার দুই দফা বৈঠকে ৩৫ জন রোহিঙ্গা উপস্থিত ছিলেন। এদের মধ্যে ২৮জন পুরুষ ও সাতজন নারী সদস্য।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা রোহিঙ্গা নেত্রী সাবেরা বেগম (৪০) বেনারকে বলেন, “তাঁদের আশ্বাসের মধ্যে রয়েছে, তাঁদের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আমাদের ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করতে পারবে। আমরা যার যার বাড়ি-ঘরে থাকতে পারব। তবে প্রথমে তারা আমাদের ক্যাম্পে নেবে। আমরা তাদের এসব কথা বিশ্বাস করি না।”
“আমরা বলেছি মিয়ানমারের ক্যাম্পে যেসব রোহিঙ্গা আছে, আগে তাদের নাগরিকত্ব দিতে। আর জেলে যারা আছে, তাদের মুক্তি দিতে,” যোগ করেন সাবেরা।
তবে হিন্দু শরণার্থী শিবিরের মাঝি শিশু শীল (৩০) বেনারকে বলেন, “আমরা তাঁদের বলেছি যে, আমাদের কোনও দাবি-দাওয়া নেই। আমাদের বার্মা সরকারের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই। তবে মিয়ানমারে থাকতে ‘আল ইয়াকিন’ আমাদের ওপর নির্যাতন করেছে। তারা নির্যাতন করবে না এই নিশ্চয়তা পেলেই আমরা এখান থেকে চলে যাব।”
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ
শনিবার ক্যাম্পের ভেতরে যখন রোহিঙ্গাদের বৈঠক চলছিল তখন অদূরে শত শত রোহিঙ্গা রাস্তার পাশে প্ল্যাকার্ড ধরে দাঁড়িয়ে তাঁদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ জানান। পরে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার আগে পুলিশ তাঁদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়।
প্রতিবাদে অংশ নেওয়া মো. শামসুল আলম জানান, “আমাদের অধিকারগুলো পূরণ হলে আমরা আজই চলে যেতে চাই। কিন্তু মিয়ানমার যা করছে সবকিছু লোক দেখানো।”
বৃদ্ধ নূর মোহাম্মদ বলেন, “আমরা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু তারা আমাদের ১৮ হাজার মা-বোনকে ধর্ষণ করেছে, হাজার হাজার মানুষ জেলে বন্দী করে রেখেছে। বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। এসবের বিচার চাওয়ার জন্য এখানে দাঁড়িয়েছি।”
দুই দিনের সফরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও হোটেল রয়েল টিউলিপে দুই দেশের প্রত্যাবাসন টাস্কফোর্সের সভায় অংশ নেয় প্রতিনিধিদল। রোববার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়।
প্রতিনিধি দলের সফর প্রসঙ্গে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম বেনারকে বলেন, “প্রত্যাবাসন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। দুই দিনের আলোচনায় প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি এটা ঠিক, কিন্তু দুই পক্ষ অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে। তিনি বলেন, এ আলোচনা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়ে গেছে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল।”
২৫ হাজার নামের তালিকা দিয়েছে বাংলাদেশ
রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার অংশ হিসেবে তথ্য যাচাইর জন্য মিয়ানমারের কাছে ৬ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের প্রায় ২৫ হাজার লোকের তালিকা দিয়েছে বাংলাদেশ।
সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায় মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে এই তথ্য জানান ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব কামরুল আহসান।
বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব কামরুল আহসান। মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্র বিষয়ক স্থায়ী সচিব মিন্ট থোয়ে।
কামরুল আহসান সাংবাদিকদের বলেন, “এক সফরে সব সমস্যার সমাধান হবে না। রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে হবে। মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের হয়তো আরও কয়েকবার আসতে হবে।”
ভারপ্রাপ্ত সচিব জানান, আগে দুই দফায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে ৮ হাজার রোহিঙ্গার পরিচয় সত্যায়িত করেছে মিয়ানমার। আজ প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে দেওয়া হয়েছে।