ভাসানচরে থাকা যাবে কি না, দেখতে যাবেন অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা নেতা
2020.07.30
কক্সবাজার ও ঢাকা

ঈদের পর কক্সবাজার থেকে অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা প্রতিনিধিকে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচর দেখাতে নিয়ে যাবার কথা জানিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা।
বর্তমান ঘিঞ্জি শরণার্থী শিবির থেকে কমপক্ষে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ওই দ্বীপে পাঠানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে এই উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
বর্তমানে প্রতিনিধিদলের তালিকা তৈরির কাজ চলছে বলে বেনারকে জানান শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)’র পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ হেমায়েতুল ইসলাম।
“প্রতিনিধিদলে শিবিরগুলোর বিভিন্ন ব্লকের মাঝিরা (নেতা) থাকবেন। তালিকা চূড়ান্ত করার কাজ চলছে এখন,” বেনারকে বলেন হেমায়েতুল ইসলাম।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহেই ৫০-৬০ জন রোহিঙ্গা নেতাকে ভাসানচর পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, “তাঁরা সরেজমিনে গিয়ে দেখে আসবেন। ফিরে নিজ নিজ শিবিরে সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অন্যদের জানাবেন।”
এসপি হেমায়েতুল বেনারকে জানান, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যাপারে সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আরআরআরসিসহ দাতা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে একটি কমিটি রয়েছে।
সম্প্রতি সেই কমিটির এক সভায় শিবির থেকে ৫০-৬০ জন রোহিঙ্গা নেতার একটি প্রতিনিধিদলকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে।
“পরিদর্শনের পর রোহিঙ্গা নেতারা ভাসানচরে যাওয়ার স্বপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে,” বলেন তিনি।
ভাসানচর পরিদর্শনের জন্য রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের তালিকা তৈরির কথা স্বীকার করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মাহবুব আলম তালুকদার বেনারকে বলেন, “এ ব্যাপারে এখনো তারিখ ঠিক করেনি সরকার।”
পরিদর্শনে আগ্রহী রোহিঙ্গা নেতারা
উখিয়ার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ রফিক বেনারকে জানান, কোরবানির পরেই রোহিঙ্গাদের ভাসানচর দেখাতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে তাঁদের।
“ভাসানচর যদি বসবাসের উপযুক্ত হয় তবে অবশ্যই রোহিঙ্গারা সেখানে যাবে। আমরা স্বচক্ষে দেখে এলে সবাইকে বোঝাতে পারব,” বেনারকে বলেন টেকনাফের শালবন রোহিঙ্গা শিবিরের হেড মাঝি মো. নুর।
“আসলে এই মুহূর্তে পরিস্কারভাবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। চর থেকে ঘুরে এসে হয়ত বলা যাবে সেখানে বাস করা যাবে কি-না,” বেনারকে বলেন ভাসানচরে যাবার জন্য তৈরি প্রতিনিধিদলের সদস্য টেকনাফের লেদা শরণার্থী শিবিরের ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম।
একই শিবিরের বাসিন্দা মোহাম্মদ সৈয়দ আলম বেনারকে জানান, গত কয়েকদিন ধরে ক্যাম্পের মাঝিরা প্রত্যেকের ঘরে ঘরে গিয়ে ভাসানচরে যাওয়ার জন্য বোঝাচ্ছেন।
“যদি কোনো পরিবার স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে রাজি থাকে, তবে তা বলার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে। তবে কাউকে জোর করা হচ্ছে না,” বলেন তিনি।
প্রতিনিধিদলে একই শিবিরের মো. হোসেনের নামও রয়েছে। বেনারকে তিনি বলেন, “এখানকার রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে না নিয়ে, যারা ক্যাম্পের বাইরে জমি ভাড়া নিয়ে বাস করছে, তাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া উচিত।”
উখিয়া-টেকনাফে এমন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এক লাখের কাছাকাছি বলেও দাবি করেন তিনি।
পদক্ষেপ অংশগ্রহণমূলক ছিল না
“এটা একটা ইতিবাচক দিক যে সরকার তাড়াহুড়া বা রোহিঙ্গাদের জোর করছে না। বরং তাঁদের বুঝিয়ে শুনিয়ে ভাসানচরে নেওয়া চেষ্টা করছে,” বেনারকে বলেন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) জেষ্ঠ্য গবেষক ড. জালাল উদ্দিন শিকদার।
“তবে এ ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ শুরুতে অংশগ্রহণমূলক ছিল না। সেটা থাকলে বিষয়টি এখনও এভাবে ঝুলে থাকত না,” যোগ করেন তিনি।
ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে এক লাখ রোহিঙ্গাকে রাজি করাতে বেশ সময় লাগবে বলে মনে করেন ড. জালাল। তাঁর ধারণা, উচ্ছেদ হওয়া এই শরণার্থীরা নিজের দেশ মিয়ানমারের সীমান্তের কাছাকাছি এলাকা ছেড়ে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে যেতে সহজে রাজি হবে না।
এদিকে বর্তমানে ভাসানচরে তিন শতাধিক রোহিঙ্গা বসবাস করছেন জানিয়ে সম্প্রতি পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানান, “আমরা দেখলাম সুপার সাইক্লোন আম্পানেও সেখানে কিছুই হয়নি। সুতরাং আগামীতে আমরা আরও রোহিঙ্গাকে সেখানে নিয়ে যেতে চাই।”
মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত যে চুক্তিগুলো রয়েছে তার অগ্রগতি কোভিডের কারণে ধীর হয়ে গেছে বলেও উল্লেখ করেন পররাষ্ট্র সচিব।
তবে ড. জালাল মনে করেন, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ এমন কোনো চাপ তৈরি করতে পারিনি যে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে, এটা আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা।
টেকসই মূল্যায়ন চায় জাতিসংঘ
মে মাসের শুরুতে উপকূল ও জলসীমা থেকে উদ্ধার হওয়ার তিন শতাধিক রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মুখপাত্র লুইস ডোনোভান বেনারকে বলেন, “ওই শরণার্থীদের জন্য সেখানে জাতিসংঘের প্রবেশাধিকার এখন খুবই জরুরি।”
“জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই সরকারকে জানিয়েছে, ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে দেখা করে তাঁদের মানবিক পরিস্থিতি এবং সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন মূল্যায়ন করতে সেখানে সফর করার জন্য আমরা প্রস্তুত আছি,” বলেন তিনি।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোনো সাড়া মেলেনি উল্লেখ করে তিনি জানান, ভাসানচরে কাউকে স্থানান্তরিত করার আগে সেখানকার সামগ্রিক সুরক্ষা পরিস্থিতির টেকসই মূল্যায়ন প্রয়োজন।
ভাসানচরকে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ আবাস হিসেবে গড়ে তুলতে অন্তত ৫৫টি বিষয় সুরাহা করা উচিত বলে মতামত দিয়েছিল জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো।
যার মধ্যে রয়েছে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগে সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকা।
রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার। জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ এবং এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের এক সভায় ভাসানচরের জন্য নেওয়া প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। বাড়তি টাকা বাঁধের উচ্চতা ১০ ফুট থেকে বাড়িয়ে ১৯ ফুট করা, আনুসাঙ্গিক সুবিধা বৃদ্ধিসহ জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণে খরচ হবে।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনাটি সরকার স্থগিত করার চিন্তাভাবনা করছে বলে জানিয়েছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান।
পরে তাঁর মন্ত্রণালয় ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশিদের একটি তালিকা তৈরি করতে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) একটি চিঠিও দিয়েছিল।
পরবর্তী মে মাসে প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, এখন থেকে ক্যাম্পের বাইরে কোনো রোহিঙ্গাকে পাওয়া গেলেই ভাসানচরে পাঠানো হবে।
তারই অংশ হিসাবে মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা ৩০০’র বেশি রোহিঙ্গাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে দুই কিস্তিতে ভাসানচরে নিয়ে রাখে সরকার।