সংকট সমাধানে রোহিঙ্গাদের আশ্বাস দিলেন ওআইসি মহাসচিব
2017.08.04
ঢাকা ও কক্সবাজার

আপডেট: ইস্টার্ন টাইম জোন দুপুর ২:১৫
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি) সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাবে বলে রোহিঙ্গাদের আশ্বাস দিয়েছেন সংস্থার মহাসচিব ড. ইউসুফ বিন আহমেদ আল-ওথাইমিন। শুক্রবার রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনকালে তিনি এই আশ্বাস দেন বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন।
এছাড়া মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
“ওআইসি মহাসচিব রোহিঙ্গাদের মুখে নির্যাতনের বর্ণনা শুনে অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছেন। তিনি তাঁদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে দ্রুত এ সমস্যা সমাধানে ওআইসি সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন,” বেনারকে বলেন জেলা প্রশাসক আলী হোসেন।
“তাঁর চোখে রোহিঙ্গাদের জন্য ভালোবাসা দেখেছি। আমাদের সমস্যা সমাধান হবে বলে তিনি আশ্বস্ত করেছেন। আমরা তাঁকে বিশ্বাস করি,” বেনারকে বলেন কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তির সভাপতি আবু সিদ্দিক।
বাংলাদেশ সফরের তৃতীয় দিনে কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন তিনি।
এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, "(রোহিঙ্গা) সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধানের জন্য ওআইসি কাজ করে যাচ্ছে এবং সমাধান না আসা পর্যন্ত ওআইসি এ ব্যাপারে প্রচারনা চালিয়ে যাবার প্রত্যয় ব্যক্ত করছে।"
“বাংলাদেশ গত দুই দশক ধরে নিঃস্বার্থভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ধন্যবাদ পেতে পারে,” বলেন তিনি।
ওআইসিভুক্ত রাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করারও আহবান জানান তিনি।
এদিকে শরণার্থী বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরু’র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ওআইসির এগিয়ে আসা প্রশংসনীয়। তবে এটা যেহেতু শুধু মুসলিম দেশগুলোর সমস্যা নয়, তাই রোহিঙ্গাদের বিষয়টি বিশ্বকে জানাতে বাংলাদেশকে আরও উদ্যোগী হতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক মনে করেন, শুরু থেকেই বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে এই সমস্যাটি তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন, পুলিশ সুপার একেএম ইকবাল হোসেন, উখিয়া ক্যাম্প ইনচার্জ মো. শামসুদ্দোহাসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম), আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও বিভিন্ন এনজিও প্রতিনিধিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
দুপুর ১২টার দিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৌঁছান ওআইসি মহাসচিব। তিনি আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) পরিচালিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার ১৭ জন রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ সঙ্গে কথা বলেন এবং তাঁদের মুখে ভয়াবহ নির্যাতনের কথা শোনেন। তিনি রোহিঙ্গা বিভিন্ন ব্লক ঘুরে দেখেন।
পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে নাগরিকত্বসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওআইসি যথাযথ ভূমিকা রাখবে।”
ওআইসি মহাসচিব আরও বলেন, এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করার জন্য আন্তজার্তিক সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টা, রাজনৈতিক সমঝোতা, সহযোগিতা, পরামর্শ এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।”
রোহিঙ্গাদের মুখে নির্যাতনের ঘটনা
যে ১৭ জন রোহিঙ্গা ওআইসি মহাসচিবের কাছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের বর্ণনা দেন তাদের একজন জামালিদা বেগম।
মংডুর পোয়াখালীর এই বাসিন্দা পরে বেনারকে জানান, “মিয়ানমার সেনাবাহিনী গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে আমাদের গ্রামে আক্রমণ করে। শুরুতেই প্রাণ বাঁচাতে আমার স্বামী পালিয়ে যায়। সেনারা বাড়িতে ঢুকে আমাকেসহ পরিবারের অন্যান্যদের মারধর করে। প্রায় মুমূর্ষ অবস্থায় আমাদের ছেড়ে যায় তারা। প্রাণে বাঁচতে পরিবার নিয়ে এপারে পালিয়ে আসি। যদি না আসতাম হয়ত এত দিনে আমার পরিবারের সবাইকে মরতে হতো।”
“এসব কথাই আমি ওআইসি মহাসচিবকে বলেছি। তিনি খুবই দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সমবেদনা জানান,” বলেন জামালিদা।
আরেক বর্ণনাকারী মো. জাকারিয়া বেনারকে বলেন, “আমাদের উপর মিয়ানমার সেনা বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালাত। অসংখ্য মানুষকে তারা হত্যা করেছে, নারীদের ধর্ষণ আর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতির কারণে আমিও সন্তানদের বাঁচাতে এপারে চলে এসেছিলাম।”
“কিন্তু এখানেও খুব কষ্টের জীবন যাপন করছি। তবে বেচেঁ আছি। ওপারে থাকলে হয়ত বেঁচেই থাকতাম না। আমার এসব কথা শুনে ওআইসি মহাসচিব সমবেদনা জানান এবং এ সমস্যা দ্রুত সমাধানের জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে আশ্বস্ত করেন,” বলেন জাকারিয়া।
চার দিনের সফরে বুধবার ঢাকা পৌঁছান ওআইসি মহাসচিব ড. ইউসুফ বিন আহমেদ আল-ওথাইমিন। নভেম্বরে দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই তার প্রথম ঢাকা সফর।
বৃহস্পতিবার তিনি রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের মুসলিম ও মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মের নেতাদের মধ্যে আন্তঃধর্মীয় সংলাপের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজার আহ্বান জানান।
গত কয়েক দশক ধরে অত্যাচারের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের অক্টোবরের পরে রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে আরো অর্ধ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে সরকার জানিয়েছে।
ওআইসি মহাসচিবকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
এসব রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ আহ্বান জানালেও মিয়ানমার সাড়া দেয়নি বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
কক্সবাজার থেকে ফিরে ওআইসি মহাসচিব শুক্রবার বিকেলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
শনিবার সকালে জেদ্দার উদ্দেশ্যে তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন বলেও ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়।