ভাসানচরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে আপত্তি
2018.08.06
ঢাকা

মিয়ানমার থেকে আসা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের উখিয়ার জনাকীর্ণ ‘মেগা ক্যাম্প’ থেকে ভাসানচরে নয়, কক্সবাজারেরই কোনো নিরাপদ স্থানে পুনর্বাসন করা উচিত বাংলাদেশ সরকারের। ব্যাংককের ফরেন করেসপনডেন্ট ক্লাব অব থাইল্যান্ডে সোমবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমনটাই দাবি করেছে হিউম্যান রাইট ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
“গত বছরের আগস্টে শুরু হওয়া মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নির্মূল অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা এই উদ্বাস্তুদের বন্যা ও ভূমিধসের শিকার হওয়া উচিত নয়। তাঁদের আরও বেশি দিন এ দেশে রাখতে পোক্ত আশ্রয়কেন্দ্র এবং পর্যাপ্ত শিক্ষার সুযোগ থাকা দরকার,” বলেছে মানবাধিকার এই সংস্থাটি।
বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বেনারকে বলেন, “এ ব্যাপারে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের কাজ চলছে।”
“বন্যা, ভূমিধস স্কুল সময় আমরা ইতিমধ্যে পেরিয়ে এসেছি। যেভাবে বলা হচ্ছিল যে এ জন্য হাজার হাজার লোক মারা যাবে, সেভাবে তেমন কিছুই কিন্তু হয়নি।”
“ভরা বর্ষার মৌসুমেও আমরা তাদের (শরণার্থীদের) নিরাপদেই রাখতে পেরেছি,” যোগ করে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, “তবুও তারা আশঙ্কার কথা জানাতেই পারে।”
“বাংলাদেশ আমার দেশ নয়: মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্ভোগ” শিরোনামের ৬৮ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনটি গত মে মাসে কক্সবাজারে সফরের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।
শিবিরে দরিদ্রভাবে গাদাগাদি করে থাকায় রোহিঙ্গারা সংক্রামক রোগ, আগুন, সামাজিক অস্থিরতা এবং পারিবারিক ও যৌন সহিংসতার উচ্চতর ঝুঁকিতে রয়েছে।
কুতুপালং-বালুখালীর ১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকার এই মেগা ক্যাম্পে বর্তমানে ছয় লাখ ২০ হাজার উদ্বাস্তু রয়েছে বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশি কর্মকর্তারা। বহিরাগমন বিভাগ ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সূত্রমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখেরও বেশি।
অন্যদিকে এইচআরডব্লিউ’র শরণার্থী অধিকার পরিচালক এবং আলোচ্য প্রতিবেদনের লেখক বিল ফ্রিলিক সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশ সাত লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে, যদিও তারা এখনো কঠিন অবস্থার মুখোমুখি।”
তাঁর অভিমত, “বাংলাদেশের উচিত পালিয়ে আসা এই রোহিঙ্গাদের ‘শরণার্থী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, তাঁদের পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য ক্যাম্পের বাইরে কাজ করার সুযোগ দেয়া।”
এ ব্যাপারে কালাম বেনারকে বলেন, “যে কোনো সংস্থা বা সংগঠন তাদের মতামত দিতে পারে। এটাও এইচআরডব্লিউ’র নিজস্ব মতামত।”
এইচআরডব্লিউ’র প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের পূর্ববর্তী তরঙ্গের শিকার হওয়া দুই লাখ পুরোনো রোহিঙ্গা অভিবাসীর সাথে গত বছর নতুন রোহিঙ্গারা যুক্ত হওয়ার পর গড়ে ওঠা মেগা ক্যাম্পটি (কুতুপালং) বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থীশিবিরে পরিণত হয়েছে।
শরণার্থী ও সাহায্য সংস্থাগুলোর ঘরগুলো শক্তিশালী ও নিরাপদ করা এবং নিরাপত্তা পরিকল্পনা উন্নয়নের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ উদ্বাস্তু প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারকে চাপে রাখতে বারবার জোর দিয়ে বলছে, ‘এই শিবিরগুলো অস্থায়ী’।
যে কারণে তারা সেখানে ঘূর্ণিঝড়-প্রতিরোধী ভবনের মতো স্থায়ী কাঠামো নির্মাণও নিষিদ্ধ করেছে এবং এমন কোনো অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি দেয়নি যা রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। এটিকে ক্যাম্পের করুণ অবস্থার অন্যতম কারণ বলে দাবি করে এইচআরডব্লিউ আরও বলেছে, এখানে শিক্ষার সুযোগও অপর্যাপ্ত।
“আমি ভূমিধসের শঙ্কা নিয়েই বাস করছি,” বলেছেন ক্যাম্পের খাঁড়া ঢালে তৈরি ঘরে চারজনকে নিয়ে বসবাসকারী ২৬ বছর বয়সী এক মা। “পাহাড় থেকে পিছলে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতে আমি ঘরের পাশে বালুর বস্তা এনে রেখেছি।”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমস্ত শরণার্থীর স্বাস্থ্য ও সার্বিক কল্যাণের জন্য তাদের পরিবেশগত ঝুঁকিতে না থাকা যথাযথ মানের পরিষেবা সমৃদ্ধ কম জনঘনত্বের ক্যাম্পে পুনর্বাসিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কারাগারে পরিণত হবে ভাসানচর
এইচআরডব্লিউ জানতে পেরেছে, কক্সবাজার থেকে উদ্বাস্তুদের স্থানান্তরের জন্য ভাসানচর নামের জনবসতিহীন একটি দ্বীপ প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।
তাদের এক চিঠির প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, শরণার্থী উপস্থিতি তাদের “সামগ্রিক অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত পরিস্থিতির জন্য ক্ষতিকর।” শিগগিরই তারা এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু করবে।
জোয়ার ও সামুদ্রিক ঢেউ থেকে রক্ষার জন্য এলাকাটি বাঁধ দ্বারা সুরক্ষিত হবে বলা হলেও এইচআরডব্লিউ মনে করছে, মেঘনা নদীর মোহনায় মাত্র ২০ বছর আগে জেগে ওঠা নোনা উদ্ভিদ ও ঘাসে ঢাকা এই দ্বীপটি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য উপযুক্ত নয়।
বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণীর বরাত দিয়ে তারা দাবি করছে, একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ঘটলে অতি প্লাবনে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হতে পারে ভাসানচর। তাছাড়া সেখানে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং জীবিকা নির্বাহের সুযোগ খুবই কম থাকবে।
ভাসানচর থেকে উদ্বাস্তুদের স্বাধীনভাবে চলাফেরার ব্যাপারেও সরকার কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি, উল্লেখ করে তারা বলেছে, পরিবেশগত ঝুঁকি থাকার পরও শরণার্থীদের সেখানে বসবাসে বাধ্য করা হলে তাদের ‘অপ্রয়োজনীয়ভাবে’ বিচ্ছিন্ন করা হবে।
তাদের বাইরে আসা-যাওয়ার সুযোগ না দেওয়া হলে দ্বীপটি একটি কারাগারে পরিণত হবে।
তবে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার বেনারকে বলেন, “এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিষয়টি পরিকল্পনার পর্যায়ে রয়েছে। এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারা এখনো কোনা প্রতিবেদন দেয়নি।”
এইচআরডব্লিউ জানায়, ভাসানচর পুনর্বাসনের একমাত্র বিকল্প নয়। বিশেষজ্ঞরা উখিয়া উপকূল এলাকার ছয়টি সম্ভাব্য স্থান রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য চিহ্নিত করেছেন, যার পরিমাণ এক হাজার তিন শ একরেরও বেশি। এই স্থানগুলো কুতুপালং-বালুখালী ক্যাম্পের আট কিলোমিটারের মধ্যে উপকূলের দিকে কাছাকাছি অবস্থিত।
শর্তসাপেক্ষে ফিরতে চায় রোহিঙ্গারা
এইচআরডব্লিউ’কে সাক্ষাৎকার দেওয়া সব শরণার্থীই বলেন, তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান। তবে এ ক্ষেত্রে শর্তগুলো পূরণ হলেই কেবল তারা স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে রাজি হবে।
এর মধ্যে নাগরিকত্ব, তাদের রোহিঙ্গা পরিচয়ের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, তাঁদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের ন্যায়বিচার, তাদের বাড়িঘর এবং সম্পত্তি ফেরত এবং তাদের নিরাপত্তা, শান্তি ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করার শর্ত অন্যতম।
“রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক অত্যাচার, অথবা তাদের বিরুদ্ধে কয়েক দশক থেকে চলমান বৈষম্য এবং নিপীড়ন মোকাবিলা করার জন্য কোনো অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণে মিয়ানমারের ব্যর্থতা, শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন বিলম্বের মূল কারণ,” বলেন ফ্রিলিক।
এইচআরডব্লিউ’র অভিমত, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সব ধরনের মানবিক চাহিদা মেটাতে দাতা দেশগুলোর সরকার ও আন্তসরকার সংগঠনগুলোকে আরও দৃঢ়ভাবে যুক্ত করা উচিত, যাতে তারা রোহিঙ্গাদের সংকট কাটাতে তহবিল সংগ্রহের পাশাপাশি তাদের নিরাপদ এবং টেকসই প্রত্যাবাসনে প্রয়োজনীয় সমস্ত শর্ত পূরণের জন্য মিয়ানমারেরর ওপর সমন্বিতভাবে চাপ রাখে।