মিয়ানমারের আপত্তিতে রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র সংশোধন হচ্ছে
2018.08.13
ঢাকা
আপডেট: ১৩ আগস্ট, ইস্টার্ন টাইম বিকেল ৫:২০
মিয়ানমারের আপত্তির মুখে এবার রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্রের ভাষা পরিবর্তন করছে বাংলাদেশ। এখন থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিবন্ধনের সময় যে পরিচয়পত্র দেওয়া হবে সেখানে ‘মিয়ানমার নাগরিক’ এর পরিবর্তে ‘রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষ’ লেখা হবে বলে বেনারকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে রাখাইন সফরকারী এক কর্মকর্তা।
মিয়ানমারের আপত্তির মুখে বাংলাদেশ আগে থেকেই কোনো আনুষ্ঠানিক ফোরামে অথবা কাগজপত্রে রোহিঙ্গা শব্দ ব্যবহার করে না।
গত শুক্রবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পরামর্শকের অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী চ তিন্ত সোয়ের সাথে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়। মন্ত্রী ঢাকায় ফিরেছেন।
শুক্রবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পরামর্শক অং সান সূচির দপ্তর থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে কক্সবাজারে বসবাসরত মানুষদের দেওয়া পরিচয়পত্রের ভাষা পরিবর্তন করতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ।
শনিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতেও একই কথা বলা হয়। তবে ভাষার কী পরিবর্তন করা হবে সে ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাখাইন সফরকারী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের এক সদস্য বেনারকে বলেন, “মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার সময় কক্সবাজারে বসবাসরত রোহিঙ্গাদেরকে আমাদের দেওয়া পরিচয়পত্রের লেখা নিয়ে আপত্তি তোলে মিয়ানমার। ওই রেজিস্ট্রেশন কার্ডে ‘মিয়ানমার নাগরিক’ লেখা আছে। তাতে তারা আপত্তি তোলে।”
তিনি বলেন, “তাদের বক্তব্য হলো বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া মানুষেরা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। তারা রাখাইনে বসবাস করত। বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বি-পাক্ষিক প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী তারা ‘রাখাইন থেকে বাস্তচ্যুত মানুষ’। মিয়ানমারের নাগরিক নয়।”
যৌথ কর্ম গ্রুপের ওই সদস্য বলেন, “আমরা তাদের কথা শুনেছি এবং আমরা একমত হয়েছি যে ওই ভাষা পরিবর্তন করে কক্সবাজারে বসবাসকারীদের ‘রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষ’ বলে পরিচয়পত্র দেওয়া হবে।”
তবে সকল রোহিঙ্গাদের নতুন করে পরিচয়পত্র দেওয়া হবে কি না, সে ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “মিয়ানমার এভাবে আমাদের ইতিহাস দুনিয়া থেকে মুছে ফেলতে চায়।”
গত বছর আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযান থেকে বাঁচতে রাখাইনের লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর শনিবার প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো কর্মকর্তা হিসাবে রাখাইন সফরে যান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
এর আগের দিন মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী। মিয়ানমার সরকারের নেতৃত্ব দেন সে দেশের রাষ্ট্রীয় পরামর্শকের অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী চ তিন্ত সোয়ে।
রাখাইন সফরে পররাষ্ট্রসচিব শহিদুল হক, শরণার্থী ত্রাণ ও পূনর্বাসন কমিশনার আবুল কালামসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে ছিলেন।
শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার আবুল কালাম বেনারকে বলেন, “সভায় প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এবং দুই দেশের মতামতের ভিত্তিতে যে ফরম প্রস্তুত করা হয়েছে সেই ফরম অনুযায়ীই প্রত্যাবাসন কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।”
তিনি বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর রাখাইন সফর নিয়ে পররাষ্ট্রসচিব সাংবাদিকদের ব্রিফ করবেন।
মিয়ানমারের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুই দেশই দ্রুত সময়ে প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায়।
তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা শব্দ ব্যবহার না করে বলা হয়, রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে দুই দেশ একমত হয়েছে।
গত বছর ২৩ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এক চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও তাঁদের দেশে ফেরানো যায়নি।
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বলছে, তাঁরা নাগরিকত্ব ছাড়া কোনোভাবেই মিয়ানমার ফিরে যাবে না। অপরপক্ষে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে রাজি নয়।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট হুমায়ূন কবির বেনারকে বলেন, “আসলে পরিচয়পত্র থেকে ‘মিয়ানমার নাগরিক’ বাদ দেওয়ার কারণ হতে পারে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার অফিশিয়াল যে শব্দ ব্যবহার করে পরিচয়পত্রে সেই শব্দ ব্যবহার করা। এটা খুব বেশি বড় ব্যাপার নয়।”
তিনি বলেন, “বড় ব্যাপার হলো রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন। বাংলাদেশের উচিত সেই দিকে নজর দেয়া। তবে, বাংলাদেশের মন্ত্রীকে রাখাইন পরিদর্শন করতে দেওয়া একটি ভালো ডেভেলপমেন্ট।”
রাখাইনে রোহিঙ্গা চলাচলের স্বাধীনতা পাবে
এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে জাতিসংঘের সাথে মিয়ানমারের সমঝোতা স্মারকের শর্ত অনুযায়ী স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের তাঁদের মূল বাসভূমি অথবা মূল আবাসস্থলের নিকবর্তী তাঁদের পছন্দমতো স্থানে নিরাপদে পুনর্বাসিত করা হবে।
ওই চুক্তিমতে, রোহিঙ্গারাও রাখাইনের অন্যান্য মিয়ানমার নাগরিকদের মতো চলাচলের স্বাধীনতা ভোগ করবেন।
জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনডিপি) ও শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এর সাথে গত ৬ জুন মিয়ানমার সরকার এই স্মারকটি স্বাক্ষর করলেও এটি আগে উন্মুক্ত করা হয়নি। চুক্তিটির একটি কপি বর্তমানে বেনারের কাছে রয়েছে।
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধানের চেষ্টা করবে বলেও এই স্মারকে উল্লেখ করা হয়। যদিও চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের রাখাইনের বাস্তুচ্যুত মানুষ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
চুক্তিমতে স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে সহায়তা করবে ইউএনএইচসিআর।