রোহিঙ্গাদের রাখাইন ফিরে যাবার পরিস্থিতি নেই
2018.08.17
ঢাকা

রোহিঙ্গাদের এখনো মিয়ানমার ফিরে যাবার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি বলে রাখাইন সফর করে এসে জানিয়েছেন বাংলাদেশি কর্মকর্তারা।
“সেখানে কোনো কাজ নেই এবং রোহিঙ্গাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে,” বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন রোহিঙ্গা সেলের প্রধান হাবিবুল কবির চৌধুরী।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার জন্য ৯ থেকে ১২ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল প্রথমে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদো ও পরে রাখাইন সফর করে। হাবিবুল কবির চৌধুরী ছিলেন ওই প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য।
রাখাইন সফর নিয়ে এই প্রথম কোনো সরকারি কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করলেন। তবে ওই সফরের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।
এদিকে সফরকারী আরেক কমকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানান, রাখাইনের মংডু ও বুছিডং-এ মাইলের পর মাইল এলাকার রোহিঙ্গা জনবসতি ও মসজিদ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বেশিরভাগই মংডু ও বুছিডং এর বাসিন্দা ছিলেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হকসহ বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের ছয়জনকে হেলিকপ্টারে করে রাখাইনের সবচেয়ে সহিংস এলাকা মংডু ও বুছিডং এ নিয়ে যাওয়া হয়।
মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মনজুরুল করিম খান চৌধুরী ও রোহিঙ্গা সেলের প্রধানসহ অন্যান্যদের রাখাইনের রাজধানী সিত্তের চার-পাঁচটি এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। প্রতিনিধিদলের সদস্যদের সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলতে দেওয়া হয়নি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীন রোহিঙ্গা সেলের প্রধান হাবিবুল কবির চৌধুরী বেনারকে বলেন, “সিত্তের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে মুসলমানদের বাড়িঘর অবরুদ্ধ। মুসলমানদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বন্ধ। তাদের কাজ নেই। আমি বলব, এখনো রোহিঙ্গাদের সেখানে ফিরে যাওয়ার অর্থাৎ সাসটেনেবল রিটার্নের মতো পরিস্থিতি হয়নি।”
তিনি বলেন, “আমরা মিয়ানমারের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে চাই।”
গত বছর ২৫ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সামরিক অভিযান থেকে বাঁচতে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শরণার্থী সমস্যা বলা হচ্ছে ওই ঘটনাকে।
জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোও বলছে, রাখাইনে ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই।
জাতিসংঘের সাথে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক প্রত্যাবাসন হতে হবে, ‘স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সাথে’। কোনো শরণার্থীকে জোর করে ফেরত পাঠানো যাবে না।
অবরুদ্ধ রোহিঙ্গা বসতি
রাখাইনের রাজধানী সিত্তের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা দেখার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে হাবিবুল কবির বলেন, “আমি মুসলিম ওই এলাকার নাম বলতে পারব না। কিন্তু এখানকার পাঁচ-ছয় তলা বাড়িগুলোর মালিক রোহিঙ্গা মুসলিমরা। ওই বাড়িগুলোতে যাওয়ার পথে কয়েক দফা পুলিশ চেক পয়েন্ট রয়েছে। বাসার ভিতরের মানুষেরা প্রকৃতপক্ষে গৃহবন্দী। কাউকে বাইরে বের হতে দেয়া হয় না। আবার বাইরে থেকে ভিতরে যেতে দেয়া হয় না।”
তিনি বলেন, “বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা তাদের খাওয়াচ্ছে। পুরো এলাকা সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহরায় থাকে।”
ওই কর্মকর্তা বলেন, “মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয়েছে রাখাইনে এখনও পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তবে আমরা সংখ্যাটি যাচাই করতে পারিনি।”
“আমার সিত্তেতে কোনো প্রকার ধ্বংস দেখিনি। ধ্বংসাত্নক কার্যক্রম চালানো হয়েছে মংডু ও বুছিডং এলাকায় যেখানে মাননীয় মন্ত্রীসহ ছয় সদস্য গেছেন,” বলেন হাবিবুল কবির।
তিনি বলেন, “আমরা সিত্তেতে বিরাট ক্যান্টনমেন্ট দেখিছি। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। তবে সেনানিবাসের পাশে বেশ কিছু জায়গা নতুন করে অধিগ্রহণ করে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। পরে আমরা জানতে পারি রোহিঙ্গারা পালিয়ে গেলে তাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।”
মংডু ও বুছিডং এর পোড়া গ্রাম
রাখাইন সফরের পর গত শনিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল রাখাইনে ‘ব্যাপক ধ্বংস দেখেছে’।
মংডু ও বুছিডং এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক অবস্থা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে নয় বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে ওই দুই এলাকা সফরকারী এক কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “আমরা সিত্তে থেকে ঘণ্টাখানেক হেলিকপ্টারে যাই। এরপর সেখান থেকে গাড়ি করে মংডু ও বুছিডং এলাকায় যাই। প্রকৃতপক্ষে আমাদের রোহিঙ্গারা বসবাস করত এমন একটি গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেটা মংডু না বুছিডং তা মনে নেই।”
ওই কর্মকর্তা বলেন, “ওই গ্রামে কিছু ঘর-বাড়ি আছে। কিন্তু অগ্নি সংযোগের চিহ্ন আছে। আমরা পোড়া মসজিদ দেখেছি।”
“মংডু ও বুছিডং এলাকায় কিছু অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে,” মন্তব্য করে ওই কর্মকর্তা বলেন, “তবে মংডু ও বুছিডং এলাকায় জীবিকা নির্বাহের সুযোগ নেই বললেই চলে।”
তাঁর মতে, “জীবনধারণের ব্যবস্থা না থাকলে অথবা নিরাপত্তা না থাকলে কোনো রোহিঙ্গা ফিরে যেতে রাজি হবে না।”
মিয়ানমারের সমাজ কল্যাণমন্ত্রী উইন মিয়াত আয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে ছিলেন বলে জানান তিনি।
“মিয়ানমার মন্ত্রী আমাদের আশ্বস্ত করছিলেন যে যারা ফিরে আসবে তাদের গ্রহণ করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, মিয়ানমারের নাগরিকত্ব পেতে রোহিঙ্গাদের এনভিসি নেয়া উচিত। কিন্তু উনি রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ব্যাপারে তেমন কোনো কথা বলেননি।”
বালুখালি শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা মো. আরিফ বৃহস্পতিবার টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “আমাদের পরিচিত যারা আরাকানে আছে তারাও বাংলাদেশে চলে আসতে চায়। মগ (বৌদ্ধ) ও মিলিটারিরা আরাকানকে জেলখানা বানিয়ে রেখেছে। সেখানে থাকা যায় না। আমাদের নাগরিকত্ব না দিলে আমরা সেখানে ফিরে যাব না।”
নাগরিকত্ব জটিলতা
“রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি জটিল,” বলে মন্তব্য করেন রোহিঙ্গা শরণার্থী বিশেষজ্ঞ ও জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর ঢাকা অফিসের সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা ড. উত্তম কুমার দাস।
তিনি বেনারকে বলেন, “প্রথম বিষয় হলো, মিয়ানমার সরকার প্রকৃতপক্ষে তাদের নিতে চায় কি না। দ্বিতীয় বিষয় হলো, রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বের প্রথম ধাপ এনভিসি নিতে রাজি কি না।”
বিদেশিরা মিয়ানমারের নাগরিত্ব চাইলে এনভিসি প্রয়োজন হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “এনভিসি না নিলে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেবে বলে মনে হয় না।”
“আবার রোহিঙ্গারা যদি এনভিসি নেয় তাহলে রাখাইনের ওপর তাদের ঐতিহাসিক দাবি ছেড়ে দেওয়া হবে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কারণ রোহিঙ্গারা তো আর বিদেশি নয়। তারা সেখানে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে বসবাস করছে।”
তাঁর মতে, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি আছে।
“রোহিঙ্গারা যদি নাগরিকত্ব ছাড়া রাখাইনে ফিরে যায় তবে তারা আবার নির্যাতনের শিকার হবে—এই আশঙ্কা অমূলক নয়,” যোগ করেন ড. উত্তম।
তিনি বলেন, সুতরাং বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাথে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখে নাগরিকত্ব ইস্যুর সমাধান করা।
তাঁর মতে, “নাগরিকত্ব ও আক্রান্ত না হওয়ার নিশ্চয়তা পেলে সব রোহিঙ্গা মিয়ানমার ফিরে যাবে।”