প্রায় আড়াই হাজার গরু কোরবানি হবে রোহিঙ্গা শিবিরে
2018.08.21
কক্সবাজার

ঈদুল আজহা উপলক্ষে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি শরণার্থী ক্যাম্পে প্রায় আড়াই হাজার গরু জবাই করা হবে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এবং ব্যক্তি উদ্যোগে এসব গরু কেনা হয়েছে, ইতিমধ্যে বেশকিছু সংখ্যক গরু ক্যাম্পগুলোতে পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম মঙ্গলবার দুপুরে বেনারকে বলেন, “কমপক্ষে আড়াই হাজার গরু জবাই করা হবে। এই সংখ্যা কিছুটা বাড়তেও পারে।”
সরকারি উদ্যোগে গরু কেনা হয়নি উল্লেখ করে কমিশনার আরও বলেন, “আমরা বিভিন্ন ব্যক্তি ও এনজিওর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জন্য যেসব গরু পেয়েছি, সেগুলো একত্রিত করে যেখানে, যতটা দরকার ততটা হিসাব করে পাঠানো হয়েছে।”
“পশুগুলো জবাইয়ের পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং ক্যাম্প ইনচার্জদের তত্ত্বাবধানে মাংস বণ্টন করা হবে,” যোগ করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এই অতিরিক্ত সচিব।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫৭।
বুধবার বাংলাদেশে ঈদুল আজহা পালিত হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রায় সবাই মুসলিম হওয়ায় তাঁরা ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিছু বিত্তবান রোহিঙ্গা নিজেদের টাকায় ভাগাভাগি করে গরু কিনেছেন।
উল্লেখ্য, ঈদুল আজহা বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ বলে পরিচিত। এই ঈদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য দেশজুড়ে লাখ লাখ পশু কোরবানি দেওয়া। এরপর পশুর মাংস তিনভাগ করে এক ভাগ দরিদ্র–দুস্থদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হয়, আরেকভাগ দিতে হয় আত্মীয়–স্বজনদের। বাকি একভাগ পশুর মালিক রাখতে পারেন।
কোরবানির পশুর মাংস খাওয়াটা অনেকের কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই ঈদে সব আনুষ্ঠানিকতা ছাপিয়ে গুরুত্ব পায় পশু কোরবানি করা, মাংস বিতরণ ও তা খাওয়ার বিষয়টি।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা যেহেতু মুসলিম, সেহেতু ওরা যাতে কোরবানির মাংস পায় সে ব্যাপারে চেষ্টা করার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। তবে কোথাও সরকারিভাবে গরু কিনে দেওয়া হয়নি।”
“আমাদের ‘টার্গেট’ অনুযায়ী কয়েক হাজার গরু পাওয়ার আশ্বাস পাওয়া গেছে। তবে মঙ্গলবার পর্যন্ত সবগুলো আমাদের হাতে পৌঁছায়নি, এগুলো ঈদের দিন সকাল পর্যন্ত আসবে।”
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ মো. রেজাউল করিম রাতে বেনারকে বলেন, “টার্গেট অনুযায়ী ২০০-২৫০ গরু পাওয়া গেলে আমি একটি ক্যাম্পের ১৩ হাজার ৫২টি পরিবারকে অন্তত দুই কেজি মাংস দিতে পারতাম। কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধ্যার মধ্যে মাত্র ৭০টি হাতে পেয়েছি।”
বুধবার সকালে আরও একশ গরু হাতে পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, “আপাতত এসব গরু দিয়েই যত জনকে পারা যায় মাংস দেওয়া হবে।”
টেকনাফে ২৪ ও ২৫ নম্বর ক্যাম্পে, অর্থাৎ লেদা ও আলীখালীর অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গার জন্য মঙ্গলবার রাত অবধি গরু পাঠানো হয়নি বলে বেনারকে জানান সেখানকার রোহিঙ্গা চেয়ারম্যান আবদুল মতলব।
এদিকে কর্মকর্তারা জানান, রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের পুরনো রোহিঙ্গাদের বাইরে থেকে গরু দেওয়া হচ্ছে না। কারণ স্বচ্ছল হওয়ায় এদের অনেকেই নিজ উদ্যোগে পশু কিনে কোরবানি দিচ্ছেন। তবে মিয়ানমার থেকে গত আগস্টের পর পালিয়ে আসা নতুন রোহিঙ্গাদের পশু কেনার আর্থিক সক্ষমতা নেই।
যদিও কুতুপালং-বালুখালী মেগাক্যাম্পের মধুরছড়া এলাকায় মঙ্গলবার সরেজমিন গিয়ে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। সেখানে অনেক রোহিঙ্গা পরিবারের বাসার সামনে কোরবানির গরু বেঁধে রাখা হয়েছে।
ক্যাম্পের আবু তাহের নামের এক বাসিন্দার সন্তান মোহম্মদ খালেক নিজেদের গরুটি দেখিয়ে জানায়, তার বাবা ৩৮ হাজার টাকায় এটি কিনেছে। কুতুপালংয়ের ক্যাম্প ইনচার্জ দাবি করেন, “নতুনদের মধ্যে বড়জোর ১০–১২ জন রোহিঙ্গা গরু কিনেছে।”
স্থানীয় কুতুপালং বাজারের গরুর হাটের ইজারাদারের প্রতিনিধি মোহম্মদ সেলিম বেনারকে বলেন, “শেষ দিনে সন্ধ্যা অবধি ১৬০টি গরু বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১০-১৫ টি গরু কিনেছে বেসরকারি সংস্থা। বাকিগুলো কিনেছে রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দারা, বিশেষ করে পুরনো রোহিঙ্গারা।”
মধুরছড়ায় ক্যাম্পের মধ্যেই গরু বিক্রি করতে দেখা যায় দ্বীন মোহম্মদকে, বয়স ৪০। তাঁর বাড়ি ছিল মিয়ানমারের আকিয়াবের নাজিরপাড়ায়। সেখানে তিনি ১৫ বছর ধরে গরুর ব্যবসা করতেন। তিনি বলেন, “আজ (মঙ্গলবার) সাতটি গরু বিক্রি হয়েছে।”
টেকনাফ থেকে ২৫টি গরু কিনে রোহিঙ্গা শিবিরে এনে বিক্রি করছেন এই রোহিঙ্গা গরু ব্যবসায়ী। তিনি জানান, মিয়ানমারে থাকাকালে কোরবানির মৌসুমে বেশ লাভ করেছেন। এখানে সামান্য লাভ হবে।
এর আগে ঈদুল ফিতরের সময়ও দ্বীন মোহম্মদ গরু জবাই করে খুচরা মাংস বিক্রি করেন।
বছরজুড়ে মাংস খায়নি অস্বচ্ছলরা
রাখাইনের বুশিডংয়ের (বুথেডং) কাইয়ুমখালী গ্রামের আদি বাসিন্দা মোহম্মদ রফিক (৪৫) বেনারকে বলেন, “এই পারে (বাংলাদেশে) আসার পর গত এক বছরে এক টুকরো মাংসও খেতে পারিনি। যাদের কাছে টাকা-পয়সা আছে তারা মাংস খেতে পারছে, তারাই কোরবানি দেবে।”
“আমি এবারের কোরবানির জন্য কোনো আয়োজনই করতে পারিনি,” বলেন তিনি। একই বক্তব্য লামার চিকনপাড়া থেকে বাংলাদেশে আসা নুরুল ইসলামের। ৫৫ বছর বয়সী এই রোহিঙ্গা জানান, ক্যাম্পের অবস্থাসম্পন্ন কিছু পরিবার কোরবানি উপলক্ষে গরু কিনেছে।
রোহিঙ্গাদের কোরবানির মাংস পৌঁছানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার উদ্যোগ নিয়েছে, এমন খবর শোনার কথা জানিয়ে নুরুল বলেন, “এবার হয়ত একটু মাংস পাব।”
আট থেকে ১০ বছর বয়সী রোহিঙ্গা শিশু আলমগীর, রফিক আলম এবং মোহম্মদ শফিক জানায়, তারাও গত এক বছরে গরুর মাংস খেতে পারেনি।
মংডুর সাপবাজার থেকে আসা ৭০ বছর বয়সী আমির আলীরও একই হাল। কোরবানির প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে শুধু বলেন, “আমার কোনও পরিবার নেই। সবাইকে ওরা (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) মেরে ফেলেছে। কার সঙ্গে ঈদ করব?”
কোরবানি: ওপার–এপারের অভিজ্ঞতা
রফিক আলম জানান, মিয়ানমারে থাকাকালে তারা কোরবানিতে কখনও পশু জবাই করতে পেরেছেন, কখনও পারেননি। সেখানে পশু জবাই করতে হলে পাঁচশ টাকা ‘ঘুষ’ দিয়ে সংশ্লিষ্টদের অনুমতি নিতে হয়েছে। অনেক সময় জবাই করা পশুর চামড়াও তাদের দিয়ে দিতে হয়েছে।
নুরুল ইসলাম জানান, “ওপারে আমরা লুকিয়ে কোরবানি দিতাম। সেনাবাহিনী খবর পেলে টাকা দিতে হতো, এমনকি পশুর চামড়াও নিয়ে যেত।”
“এই অবস্থার মধ্যে তবুও সেখানে কোরবানি করতে পেরেছি। এখানে কোরবানি করতে কেউ বাধা দেয় না, কিন্তু সেই আর্থিক সঙ্গতি আর নেই,” বলেন নুরুল।