মিয়ানমারকে সতর্ক করল রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন
2017.08.22
ঢাকা ও কক্সবাজার

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন বন্ধে মিয়ানমার সরকারকে সতর্ক করেছে রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ)। অন্যথায় রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিশোধ নেওয়ার কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে তাঁরা।
সম্প্রতি ইউটিউবের মাধ্যমে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় এআরএসএ নেতা আতাউল্লাহ আবু আম্মা জুনুনি নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তবে এ লড়াই ‘একান্তই নিজেদের’ উল্লেখ করে এতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে আশ্বস্ত করেন সংগঠনের ‘কমান্ডার ইন-চার্জ’ বলে পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তি।
১৮ মিনিটের বেশি ওই ভিডিও বার্তায় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রচেষ্টার প্রশংসা করা হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকার দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে। তবে এআরএসএ’র সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সম্পৃক্ততা নেই উল্লেখ করে তিনি জানান, মিয়ানমার শাসকদের নির্যাতন থেকে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের মুক্ত করাই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য।
“বিশ্বের কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা নেই। কারও কাছ থেকে আমরা অর্থ গ্রহণ করি না। ন্যাটোসহ যেকোনো তদন্ত সংস্থা চাইলে এ বিষয়ে তদন্ত করতে পারে,” দু’পাশে চারজন মুখ ঢাকা অস্ত্রধারী নিয়ে একটি জঙ্গল এলাকার মধ্যে চেয়ারে বসে দেওয়া বক্তব্যে দাবি করেন এআরএসএ কমান্ডার ইন-চার্জ।
হারকাত আল-ইয়কিন নামে পরিচিত রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন চলতি বছরের মার্চ মাসে নাম পরিবর্তন করে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (এআরএসএ) নামে আত্মপ্রকাশ করে। এর প্রধান আতাউল্লা সম্পর্কে প্রথম জানা যায় ব্রাসেলস ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) গত ডিসেম্বরের একটি প্রতিবেদন থেকে।
আইসিজি প্রতিবেদন মতে, আতাউল্লার জন্ম পাকিস্তানে। তাঁর বাবা রাখাইন রাজ্য থেকে ধর্মীয় নিপীড়নে পাকিস্তানে অভিবাসী হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর পরিবার সৌদি আরবের মক্কায় বসবাস শুরু করে এবং সেখানেই আতাউল্লা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হন।
প্রতিবেদন মতে, ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বৌদ্ধদের সংঘাতের পরপরই আতাউল্লা সৌদি আরব ছেড়ে চলে আসেন বলে ধারণা করা হয়।
“পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও ধারণা করা হয় যে, তিনি (আতাউল্লা) অস্ত্রচালনা ও আধুনিক গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণের জন্য সৌদি আরব থেকে পাকিস্তানে; এবং খুব সম্ভবত আরো কোথাও পাড়ি জমান,” জানায় প্রতিবেদনটি।
এআরএসএ’র সদস্য সংখ্যা সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না এবং মিয়ানমনারও আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠনটির অস্তিত্ব স্বীকার করে না।
তবে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ক্যাম্পগুলোতে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটির লোকজন রয়েছে।
“উখিয়া-টেকনাফে মিয়ানমার বিচ্ছিন্নতাবাদী রোহিঙ্গা সংগঠনের প্রায় দেড় শতাধিকের বেশি সদস্য রয়েছে। তারা এপার-ওপারে যাতায়াত করে থাকে,” বেনারকে বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উখিয়া শরণার্থী শিবিরের এক নেতা।
এদিকে টেকনাফের লেদা শরণার্থী ক্যাম্পের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্য এক রোহিঙ্গা নেতা বেনারকে বলেন, “এআরএসএ’র লোকজন কিছুদিন আগে এপারে ঢুকে উখিয়া, কুতুপালং ক্যাম্পে অবস্থান নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে বাংলাদেশের দুর্নাম হয় এমন কোনো কিছু তাঁরা করেন না।”
তবে বাংলাদেশে এই সংগঠনটির অস্তিত্ব অস্বীকার করে টেকনাফে বিজিবি-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের যেকোনো নাগরিক যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে সীমান্ত জুড়ে কঠোর সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বিজিবি। এপারে মিয়ানমারের কোনো বিদ্রোহী সংগঠনের কোনো কর্মকাণ্ড নেই এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কড়া নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এ ভিডিও সম্পর্কে জানা নেই মন্তব্য করে এ ধরনের সংগঠনের সাথে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই বলে বেনারকে জানান।
“আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অনুসারে, আমরা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করি না। বাংলাদেশের ভূমি কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্য নয়, এটিই বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের নীতি,” বলেন তিনি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, রাখাইন রাজ্যের গভীর বনে সক্রিয় এআরএসএ’র উপস্থিতি ওই অঞ্চলে ধর্মীয় উত্তেজনা বাড়াতে পারে। তাছাড়া সংগঠনটির প্রতি পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিগোষ্ঠীও আকৃষ্ট হতে পারে।
২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর এআরএসএ’র বিদ্রোহীরা (তখন হারকাত আল-ইয়কিন নামে পরিচিত) মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের চৌকিতে হামলা করে নয় সদস্যকে হত্যা করে ও ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করে দায়িত্ব স্বীকার করে।
এর প্রেক্ষিতে মিয়ানমার সরকার ওই অঞ্চলে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানের সময় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।। প্রাণে বাঁচতে প্রায় ৭৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নেয়।