‘বিচ্ছন্ন প্রজন্মে’ পরিণত হতে পারে রোহিঙ্গা শিশুরা: ইউনিসেফ
2018.08.23
কক্সবাজার

বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষা বঞ্চিত রোহিঙ্গা শিশু একটি ‘বিচ্ছিন্ন প্রজন্মে’ পরিণত হতে পারে বলে বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ।
এদিকে বৈধ জীবিকার সুযোগ না থাকায় শরণার্থী শিবিরগুলোর প্রায় পাঁচ লাখ পূর্ণবয়স্ক নারী-পুরুষ হতাশা ও অপরাধ প্রবণতার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত বছরের আগস্টের পর ব্যাপক হারে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বর্ষপূর্তিকে সামনে রেখে তৈরি ইউনিসেফের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, রোহিঙ্গা শিশুরা কবে নিজেদের দেশে ফিরে যেতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা ছাড়াই অতি সামান্য সুযোগের ভেতর এক অনাকাঙ্খিত ভবিষ্যত নিয়ে বড়ো হচ্ছে।
“আমরা যদি এখনই শিক্ষায় বিনিয়োগ না করি, তাহলে রোহিঙ্গা শিশুদের একটি ‘বিচ্ছিন্ন প্রজন্ম’ দেখার আশঙ্কা রয়েছে, যাদের একদিকে যেমন বর্তমান বাস্তবতা সামলে চলার দক্ষতার অভাব রয়েছে, তেমনি যখন মিয়ানমার ফিরে যাবে, তখন তারা নিজেদের সমাজে ভূমিকা রাখতেও ব্যর্থ হবে,” বলেন ইউনিসেফ বাংলাদেশর মুখপাত্র এডওয়ার্ড বেগবেডার।
চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ১ হাজার দুইশ শিক্ষা কেন্দ্রে এক লাখ চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গা শিশুকে ভর্তি করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্তু রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য সর্বসম্মত কোনো শিক্ষাক্রম তৈরি সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি, অতিরিক্ত শিক্ষার্থী বোঝাই শ্রেণিকক্ষগুলোতে খাবার পানিসহ অন্যন্য সুযোগ সুবিধার অভাব রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়।
এতে বলা হয়, রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য মানসম্মত ও জীবনমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জরুরি বিনিয়োগ সহায়তা প্রয়োজন। বিশেষ করে কন্যাশিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য, যারা এখন পর্যন্ত বিশেষায়িত সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
এদিকে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বর্তমানে ৬ হাজারের বেশি অনাথ রোহিঙ্গা শিশু রয়েছে বলে গতকাল বুধবার এক বিবৃতিতে জানায় সেভ দ্য চিলড্রেন। এসব শিশুরা গত বছরে রাখাইনের সহিংসতায় নিজেদের বাবা মাকে হারিয়ে বাংলাদেশে এসেছে।
ত্রাণনির্ভর জীবনে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা
বৈধ জীবিকার সুযোগ না থাকায় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি ক্যাম্পের প্রায় পাঁচ লাখ পূর্ণবয়স্ক নারী-পুরুষের ত্রাণনির্ভর জীবন অনেককে একদিকে অলস করছে, অন্যদিকে নানা ধরনের অপরাধ প্রবণতায় আকৃষ্ট করছে।
ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) হিসাব অনুযায়ী, উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে ৪২ শতাংশ পূর্ণ বয়স্ক বা কর্মক্ষম। এদের মধ্যে গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়ে বা প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা সাত লাখেরও বেশি।
দীর্ঘদিনের কর্মহীনতায় রোহিঙ্গাদের অপরাধ প্রবণতা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা পুলিশ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের।
জেলা পুলিশের হিসেবে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গত এক বছরে কক্সবাজারের বিভিন্ন থানায় অন্তত ৫০০ মামলা হয়েছে। মাদক ব্যবসা ও পাচার থেকে শুরু করে খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি ও অস্ত্র মামলাও এর মধ্যে রয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা এক হাজারের কাছাকাছি।
“এমন কোনও অপরাধ নেই যা তারা (রোহিঙ্গারা) করার চেষ্টা করে না। আর দীর্ঘদিন কাজ না থাকলে স্বভাবতই মনে দুষ্টচিন্তা আসে,” বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. এ কে এম ইকবাল হোসেন।
জেলা পুলিশের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদকের, এরপর খুনের। গত এক বছরে সেখানে ৩০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা—ইউএনএইচআরসির মুখপাত্র জোসেফ সূর্য ত্রিপুরা বেনারকে বলেন, “জীবিকার অভাবে তাদের মধ্যে যে হতাশা তৈরি হয়েছে সে বিষয়টি আমরাও খেয়াল করেছি। আসলে সব মানুষই নিজের পরিবারকে সাহায্য করতে চায়।”
“কর্মক্ষম সব রোহিঙ্গাই চায়, নিজের পরিবারের সদস্যরা একটু ভালো থাকুক। যে কারণে এখানে তাদের জীবিকার সুযোগ থাকা উচিত,” বলেন তিনি।
দেশের কারাগারগুলোর মতো শরণার্থী শিবিরেও বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ শিখিয়ে রোহিঙ্গাদের আত্মনির্ভরশীল করার উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এবিএম নাজমুস সাকিব।
এ ব্যাপারে তাঁর অভিমত, “বসিয়ে রাখলে তাঁদের অপরাধ প্রবণতা আরো বেড়ে যাবে, তাঁদের যদি উপার্জনক্ষম কোনও কাজে জড়ানো যায়, তবে অপরাধ কমবে।”
অবশ্য টেকনাফের রোহিঙ্গা নেতা মোহম্মদ রশিদ এবং দিল মোহাম্মদের অভিযোগ, বেকারত্ব ছাড়াও রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ স্থানীয় বাসিন্দাদের প্ররোচনা বা সহায়তা।
“কর্মক্ষম বেকার রোহিঙ্গার সংখ্যা কত সে বিষয়ে আমাদের কাছে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই,” উল্লেখ করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, “তারা ক্যাম্পের ভিতরে টুকটাক ব্যবসাসহ কিছু কাজ করতে পারছে। এর চেয়ে বেশি সুযোগ দেওয়া আপাতত সম্ভব না।”
বাইরে কাজ করতে না পেরে ক্ষোভ
বুসিডংয়ের তমবাজার থেকে আসা ৩৫ বছর বয়সী মোহম্মদ তাহের বেনারকে বলেন, “আমরা ক্যাম্পের বাইরে কোথাও গিয়ে কাজ করতে পারি না। এটাই আমাদের সব কষ্টের মূল কারণ। কোনও আয় নেই বলে নিজেদের কোনও সমস্যা সমাধান করতে পারি না।”
মংডুর দক্ষিণের দুমচাপাড়া থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ৩৭ বছর বয়সী মোহম্মদ হোসেন বেনারকে জানান, এনজিওগুলোর বিভিন্ন প্রকল্পে কাজের কিছু সুযোগ থাকলেও তা অপ্রতুল। এই কাজও আবার সব সময় থাকে না।
তবে উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বেনারকে জানান, লুকিয়ে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে দিনমজুরি ও রিকশা চালানোর পাশাপাশি ছোটখাটো কাজ করছে কর্মক্ষম রোহিঙ্গারা।
উখিয়ার কুতুপালং-বালুখালীর মেগাক্যাম্পে সরেজমিনে দেখা গেছে, অনেক রোহিঙ্গা বরাদ্দ পাওয়া বাসার সামনেই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ছোট ছোট দোকান দিয়েছেন।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।