দেশান্তরের পাঁচ বছর: জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তত্ত্বাবধানে ফিরতে চান রোহিঙ্গারা
2022.08.25
কক্সবাজাৱ

চরম নির্যাতন ও দমন-পীড়নের মুখে পাঁচ বছর আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তত্ত্বাবধানে ফিরে যেতে চান নিজেদের মাতৃভূমিতে।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পাঁচ বছর উপলক্ষে কক্সবাজারের উখিয়ায় আয়োজিত সমাবেশ ও মানববন্ধন থেকে বৃহস্পতিবার এই দাবি জানান রোহিঙ্গা নেতারা।
২৫ আগস্ট বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টার দিকে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে 'হোপ ইজ হোম' শ্লোগান সামনে রেখে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে মিয়ানমারে গণহত্যার বিচার, দ্রুত প্রত্যাবাসনসহ বেশ কয়েকটি দাবি তুলে ধরেন রোহিঙ্গা নেতারা।
গত বছর আততায়ীদের হাতে নিহত প্রত্যাবাসনপন্থী শীর্ষ রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহকে স্মরণ করে শুরু হওয়া সমাবেশে মিয়ানমারের জান্তা সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নির্যাতনের কথা তুলে ধরে গণহত্যার বিচার দাবি করেন মৌলভী নুর হোসাইন।
শান্তিপূর্ণভাবে রোহিঙ্গাদের কর্মসূচি শেষ হয়েছে উল্লেখ করে ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আমির জাফর জানান, তাঁর উখিয়ায় ২২টি ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সমাবেশ উপলক্ষে কুতুপালং, বালুখালী, লম্বাশিয়াসহ আশপাশের ক্যাম্প থেকে সকাল থেকে লোকজন খেলার মাঠে জড়ো হতে শুরু করেন। সমাবেশে পুরুষদের পাশাপাশি রোহিঙ্গা নারী, শিশুরাও যোগ দেন। পোস্টার, প্ল্যাকার্ডে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার দাবি তুলেন।
সমাবেশে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, “আজকে গণহত্যা দিবস পালন করেছি। কারণ এইদিনে মিয়ানমার জান্তা সরকার আমাদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। আমরা শরণার্থী হয়ে থাকতে চাই না। সোনালি আরকানে ফিরতে চাই।”
“টেকসই প্রত্যাবাসন যাতে দ্রুত শুরু হয়, সেজন্য মিয়ানমার সরকারকে আরো চাপ দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি,” যোগ করেন তিনি।
সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতারা অভিযোগ করেন, নানা ষড়যন্ত্র ও ছলচাতুরীর মুখে রোহিঙ্গা সংকটের পাঁচ বছর পূর্ণ হলেও একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার।
২০১৭ সালে মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হন রোহিঙ্গা নারী জামালিদা বেগম।
সেই সময়ের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন জামালিদা।
“আমরা কীভাবে এখানে এসেছি, আমাদের দিনগুলো কী রকম ছিল এসব মনে পড়লে খুব খারাপ লাগে,” বলেন জামালিদা।
সমাবেশে মিয়ানমারের পার্লামেন্টে রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিও তুলেছেন রোহিঙ্গা নেতারা।
এছাড়া প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ওআইসি, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ দাতা সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন রোহিঙ্গা নেতারা।
সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতা নুর কামাল বলেন, “শরণার্থী জীবনের পাঁচ বছর পার হলেও প্রত্যাবাসনের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না হওয়ায় আমরা হতাশ।”
'গণহত্যা দিবস’ পালনের সকল প্রস্তুতি থাকলেও নিরাপত্তাজনিত কারণে টেকনাফে কোনো সমাবেশের অনুমতি পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গারা। অন্যদিকে “আর্থিক সংকটের” কারণে ভাসানচরের রোহিঙ্গারাও কোনো আয়োজন করেননি বলে জানিয়েছেন।
প্রত্যাবাসনই সংকট সমাধানের একমাত্র পথ
গত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশ যে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে তা বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের জন্য “ভীষণ চাপের ব্যাপার,” বলে বৃহস্পতিবার মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন।
ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ‘রোহিঙ্গা সংকট প্রত্যাবাসনের উপায়’ শীর্ষক সেমিনারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেন, “স্বেচ্ছায় এবং টেকসই প্রত্যাবাসনই এই সংকটের একমাত্র সমাধান।”
অপরদিকে, ঢাকায় জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত নয়েলিন হেইজারের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চায় এবং এরই মধ্যে ৩৪ হাজার ৪০০ জনের যে নাগরিক তালিকা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে, সেটি যাচাই-বাছাই করে এ তালিকা থেকেই প্রত্যাবাসন শুরু করবে দেশটি এমন তথ্য জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আশা করা যাচ্ছে কিছু সংখ্যক হলেও প্রত্যাবাসন শুরু হবে।
এদিকে মিয়ানমার বিষয়ক জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত নয়েলিন হেইজার বাংলাদেশে তাঁর চার দিনের সফরের তৃতীয় দিন বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ এবং টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরির দায়িত্ব মিয়ানমারের।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা জনগণের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী দেশটির রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর যে নিষ্ঠুর অভিযান শুরু করে তা আন্তর্জাতিক মহলে গণহত্যা হিসেবে গণ্য হয়েছে।

মন্তব্য নেই মিয়ানমারের, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিবৃতি
রোহিঙ্গা সংকটের পাঁচ বছর উপলক্ষে বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়া থেকে বৃহস্পতিবার যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি মিয়ানমার সামরিক সরকারের মুখপাত্র।
বাংলাদেশ সফরের আগে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত নয়েলিন হেইজা মিয়ানমার সফর করেছেন। সেখানে তাঁর সাথে মিয়ানমার সামরিক সরকারের প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অঙ হ্লাইং গত ১৭ আগস্ট এক বৈঠকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে আলোচনা করেন বলে এক বিবৃতিতে জানায় দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়।
এতে রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে উল্লেখ করা হয়।
“আন্তর্জাতিক দাবি অনুযায়ী নয়, বরং আমাদের আইন অনুযায়ী যাচাই বাছাইর পরই শুধু আমরা বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী গ্রহণ করব,” বৈঠকে বলেন জেনারেল মিন অঙ হ্লাইং।
শরণার্থীদের মধ্যে যারা আগে মিয়ানমারে বসবাসের প্রমাণ দেখাতে পারবে, শুধু তাঁদেরকেই গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিনকেন।
বাংলাদেশসহ আশপাশের অঞ্চল থেকে রোহিঙ্গাদের চাপ কমাতে তাঁদের অন্য কোনো দেশে পুনর্বাসনের জন্যও কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এছাড়াও রোহিঙ্গা সংকটের পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল ব্যাশেলেটসহ বিবৃতি দিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকার কর্মীরা।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে আহম্মদ ফয়েজ।