পরিবেশের ক্ষতি পোষাতে রোহিঙ্গা শিবিরে তিন লাখ বৃক্ষ রোপণ

সুনীল বড়ুয়া
2020.08.26
কক্সবাজার
200826_Coxs_Plantetion_1000.jpg পরিবেশের ক্ষতি কমাতে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে গাছের চারা লাগিয়ে বৃক্ষরোপণ কর্মসুচির উদ্বোধন করছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মাহাবুব আলম তালুকদার (বামে) ২৬ আগস্ট ২০২০।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা বসতির কারণে উজাড় বনাঞ্চলের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চলতি বর্ষা মৌসুমে তিন লাখের বেশি গাছের চারা লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে সেবাসংস্থা ও বাংলাদেশ বনবিভাগ।

এই তথ্য নিশ্চিত করে শরণার্থী শিবিরগুলোতে সেবাসংস্থাগুলোর সমন্বয় সংস্থা ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের মুখপাত্র সৈকত বিশ্বাস বেনারকে জানান, চলতি বর্ষা মৌসুমে কক্সবাজারের ৩৪টি শরণার্থী শিবির জুড়ে ১২০ হেক্টর জমিতে এই বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি চলবে।

শরণার্থী শিবির এলাকায় গত দুই বছরে ৩৫০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় সাড়ে সাত লাখ গাছের চারা লাগানো হয়েছে জানিয়ে সৈকত বলেন, ওইসব গাছের “৮০ ভাগ জীবিত আছে।”

“আমরা আশা করছি, এ বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি শিবিরগুলোতে বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি পোষাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে,” যোগ করেন সৈকত।

চলতি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে জলাশয়ের তীরবর্তী বনভূমি রক্ষা, পাহাড়ের ঢাল সুরক্ষা ও সড়কের আশেপাশের ভাঙন নিয়ন্ত্রণকে মাথায় রেখে দেশজ বৃক্ষ প্রজাতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

তাঁর মতে, এর ফলে পরিবেশের ক্ষতি পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি, বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে বসবাস করা বিপুল সংখ্যাক রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি পরিবার উপকৃত হবে।

রোপণ করা গাছগুলোকে টিকিয়ে রাখতে রোপণের পর ৮ মাস ব্যাপী রক্ষণাবেক্ষণও করা হবে বলে জানান সৈকত।

বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের আগস্টের পরে বাংলাদেশে আসা প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গার বসতি নির্মাণ ও জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের কারণে গত তিন বছরে উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় সাড়ে ছয় হাজার একর বন ধ্বংস হয়ে গেছে।

এর ফলে হুমকির মুখে পড়েছে ওইসব অঞ্চলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। অর্থমূল্যের হিসাবে গত তিন বছরে ওইসব এলাকায় বনজদ্রব্য এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির পরিমাণ সাড়ে চারশ’ কোটি টাকার বেশি।

রোহিঙ্গারা আসার আগে টেকনাফ ও উখিয়ার বনাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ, গাছ, লতা, গুল্ম, বেত, ঔষধি ছাড়াও চাপালিস, গর্জন, সেগুনসহ ১৫-২০ প্রজাতির রোপণ করা গাছ ছিল বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার দক্ষিণের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. হুমায়ন কবীর।

তিনি বলেন, “আমরা তাঁদের পরামর্শ দিয়েছি এসব প্রজাতির দীর্ঘ মেয়াদী গাছের চারা লাগানোর জন্য।”

“রোহিঙ্গাদের চাপে যে পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতি বনের হয়েছে তা কোনদিনও পূরণ করা যাবে না,” মন্তব্য করে তিনি আশঙ্কা করেন, “এখন যে চারাগুলো লাগানো হচ্ছে, দেখা যাবে সেগুলো রোহিঙ্গারাই কেটে ফেলবে।”

তবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের প্রথম দিকে রোহিঙ্গারা রান্নার জ্বালানির জন্য গাছ কাটলেও এখন প্রতিটি পরিবারকে গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ করার কারণে জ্বালানির জন্য গাছ কাটা হচ্ছে না বলে জানান সৈকত বিশ্বাস।

তিনি বলেন, “উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি শিবিরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের প্রতিটি পরিবার এখন জ্বালানী হিসাবে গ্যাস সুবিধা পেয়ে থাকে।”

‘ক্যাম্পগুলো আবারও সবুজ ভরে উঠবে’

মিয়ানমার থেকে প্রাণে বাঁচতে উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে এসে বনাঞ্চল উজাড় করে বসতি স্থাপন করলেও বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন রোহিঙ্গারা।

“গাছ-গাছালি না থাকার কারণে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ধূ ধূ মরুভুমির মতো,” মন্তব্য করে আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল ইউনিয়ন-এর সেক্রেটারি মাস্টার মো. ইলিয়াছ বেনারকে বলেন, “গাছ-গাছালি থাকলে ক্যাম্পগুলোর পরিবেশ অনেক সুন্দর হয়ে উঠবে। পাশাপাশি, অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়বে।”

তিন বছর ধরে বনায়ন কর্মসূচি চললেও গাছগুলো ছোট থাকায় আগে তেমন চোখে পড়ত না জানিয়ে রোহিঙ্গা নেতা মো. নূর বেনারকে বলেন, “তিন বছরে কিছু কিছু গাছ অনেক বড় হয়েছে। এখন বনায়ন কর্মসুচি দৃশ্যমান হয়েছে।”

“গাছগুলো বড় হয়ে গেলে ক্যাম্পের পরিবেশ অনেক সুন্দর হবে এবং পরিবেশও রক্ষা পাবে,” বলেন নূর।

“রোহিঙ্গা বসতির কারণে এসব এলাকা বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়েছিল” মন্তব্য করে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মাহবুব আলম তালুকদার বেনারকে বলেন, “এখন সেখানে আবার বনায়ন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ক্যাম্পগুলো আবারও সবুজ সবুজে ভরে উঠবে।”

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করেন। যার মধ্যে সাড়ে আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাস করেন উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি শরণার্থী শিবিরে। এদের বেশিরভাগই থাকেন বনবিভাগের জমিতে।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশান অব নেচার (আইওসিএন) এর ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবির এলাকা হুমকির মুখে থাকা এশিয়ান হাতির স্বাভাবিক বাসস্থান, বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র।

ওইসব এলাকায় বাস করে ৬৩টি এশিয়ান হাতি।

হাতি বিচরণের এসব এলাকায় রোহিঙ্গা বসতি স্থাপনের ফলে হাতির আক্রমণে এখন পর্যন্ত অন্তত ১২জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।