মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিচার চাইল জাতিসংঘের তদন্তকারী সংস্থা

বেনার নিউজ
2018.08.27
ওয়াশিংটন ডিসি
মিয়ানমার বিষয়ক জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান মারজুকি দারুসম্যান জেনেভার সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন
AFP

মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা সংগঠনের জন্য দেশটির সেনা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিচার দাবি করেছেন জাতিসংঘের তদন্তকারী সংস্থা। এই গণহত্যার ফলে হাজারো রোহিঙ্গার প্রাণহানি ঘটেছে এবং ৭ লক্ষের বেশি মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায় বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। গত সোমবার এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের তদন্তকারী সংস্থাটি এমন দাবি জানিয়েছেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সমর্থনে গঠিত ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্তকারী এই ফাইন্ডিং কমিটি মিয়ানমারের এই ঘটনাটিকে হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নেয়ার দাবী জানান।

সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা সংঘটনের অভিযোগে দেশটির সেনাপ্রধান ও অপর পাঁচ শীর্ষ সেনা কমান্ডারকে বিচারের মুখোমুখি করতে আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের তদন্তকারীরা।

রাখাইন, কাচিন, শান রাজ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের জন্য একই পদক্ষেপ দাবী করে সংস্থাটি বলেছে, ''নিঃসন্দেহে সহিংসতার অধিকাংশ ঘটনাগুলো আন্তজার্তিক অপরাধের মানদন্ডের বিচারে জঘন্যতম অপরাধ।''

তদন্তকারী কর্মকর্তারা মিয়ানমারের উপর অস্ত্র অবরোধের আহবান জানিয়েছেন জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের কাছে। এছাড়া, ঘটনা বিচারের জন্য বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে পাঠানোর জন্য আহবান জানানো হয়েছে জাতিসংঘের এ প্রতিবেদনে।

অং সান সু চি সমালোচনা

এই প্রতিবেদনে নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী অং সান সু চি' রও কঠোর সমালোচনা করা হয়।

বলা হয়, সরকার প্রধান হিসেবে সু চি তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি নৈতিক ভাবেও তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

''অসম সামরিক পদক্ষেপ''

উল্লেখ্য, গত বছরের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা চেকপোস্টে হামলা চালায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এরপরই মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ শুরু করলে ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। এই রিপোর্টটি এই ঘটনার এক বছর পূর্তির কিছুদিন পরেই প্রকাশিত হলো।

জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরসার আক্রমণ মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ছিলো। কিন্তু  নিরাপত্তা ঝুঁকির তুলনায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পদক্ষেপ  ''অনেক বেশি অসম''  ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে।

রিপোর্টে বলা হয়, নির্বিচার হত্যা, গণধর্ষণ, শিশু নির্যাতন এবং গ্রাম পুড়িয়ে দেয়ার মতো সামরিক কার্যক্রম কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।

এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার সময়

এশিয়ান হিউমান রাইটস কাউন্সিলের একজন আইনজীবি মিন লিন উ বলেন, ''আমি মনে করি আন্তজার্তিক চাপের কারণে জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এটা মিয়ানমারের জেনারেলদের জন্য একটা সতর্কবার্তা হতে পারে, যাতে ভবিষ্যতে তারা এই ধরণের কাজ না করেন।'' রেডিও ফ্রি এশিয়াকে তিনি বলেন।

তিনি আরও যোগ করেন, জাতিসংঘের আরও অকাট্য প্রমাণ দরকার। কেবলমাত্র মৌখিক স্বাক্ষীর উপর ভিত্তি করে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না।

মিয়ানমার রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকের তুন খিন বলেন, ''যেহেতু এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, জাতিসংঘের জন্য এটাই উপযুক্ত সময় এই বিষয়ে একটি কঠোর সিদ্ধান্ত নেবার। ''

তিনি রেডিও ফ্রি এশিয়াকে আরও বলেন,  আমরা গত দুই বছরে অনেক বিবৃতি প্রকাশিত হতে দেখেছি। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখিনি। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেবার সময়।

রোহিঙ্গারাও ন্যায় বিচার চায়

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মণি বেনারকে বলেন, বাংলাদেশের উচিত জাতিসংঘের সাথে একাত্নতা ঘোষণা করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা, জাতিগত নির্মূল অভিযান ও নির্যাতনের জন্য দায়ী মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বিচার চাওয়া উচিত।

তিনি বলেন, “অবশ্যই জেনারেলদের বিচার দাবী করা উচিত। আমরা সবসময় জবাবদিহিতার কথা বলি। গণহত্যা, নির্যাতন ও জাতিগত নির্মূল অভিযানের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি করা না গেলে রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্বিচত করা যাবে না। ও তারা তাদের দেশে ফিরে যেতে নিরাপদ বোধ করবে না।”

দীপু মণি বলেন, “কেউ গণহত্যা চালাবে, নির্যাতন করবে, জাতিগত নির্মূল অভিযান চালাবে আর তাদের বিচার হবে না—এটা হতে পারে না।”

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা সরকারিভাবে এখনো জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রতিবেদনের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেইনি।”

তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মত আমরাও চাই রাখাইনে যেসকল রোহিঙ্গা নির্যাতনের শিকার হয়েছে, জাতিগত নির্মূলের শিকার হয়েছে তারা যেন বিচার পায়। পূর্ণ নাগরিক অধিকারের সাথে তারা যেন তাদের নিজস্ব বাড়িঘরে ফিরে যেতে পারে।”

টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের ডেভলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব বলেন, "এই বক্তব্যের জন্য জাতিসংঘকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা আশাকরি, নিরাপত্তা পরিষদ দ্রুতই মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের ব্যবস্থা করবে।"

তিনি আরও বলেন, "এছাড়া মিয়ানমারের বেসামরিক যেসব লোকজন রোহিঙ্গা নিধনের সাথে ছিলেন, বা এটা সমর্থন করেছেন; আমরা তাদেরও বিচার চাই।"

একাউন্ট মুছে ফেলছে ফেসবুক

এদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্কিত ১৮ টি একাউন্ট, একটি ইনস্টাগ্রাম একাউন্ট এবং ৫২ টি ফেসবুক পেইজ সরিয়ে ফেলেছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।

এক বিবৃতিতে ফেসবুক জানিয়েছে, মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং লাইংসহ ২০ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ফেসবুকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় উত্তেজনা যেন আর বৃদ্ধি না পায়, এ পদক্ষেপ সে জন্যই নেওয়া হয়েছে।

মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা সংঘটনের অভিযোগে দেশটির সেনাপ্রধান ও অপর পাঁচ শীর্ষ সেনা কমান্ডারকে বিচারের মুখোমুখি করতে জাতিসংঘের তদন্তকারীদের আহ্বানের পরই ফেসবুকের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হলো।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী ও কক্সবাজার থেকে শরীফ খিয়াম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।