মিয়ানমারকে যৌথ জঙ্গিবিরোধী অভিযানের প্রস্তাব দিলো ঢাকা
2017.08.28
ঢাকা ও কক্সবাজার

আপডেট: ইস্টার্ন টাইম জোন বিকেল ৫:৩০
রাখাইন রাজ্যে চলমান সামরিক অভিযানের ফলে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে সোমবার মিয়ানমারের কাছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি যৌথ সামরিক অভিযানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক।
সোমবার ঢাকায় মিয়ানমার দূতাবাসের চার্জ-দ্য-অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) অং মিন্টকে দ্বিতীয় দিনের মতো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতা ও নির্বিচার সামরিক অপারেশন নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
“আজ (সোমবার) আমি সিডিএ-কে ডেকে একটি প্রস্তাব দিয়েছি। প্রস্তাবে আমরা বলেছি, জঙ্গি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাদের (মিয়ানমার) ও আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী সীমান্ত এলাকায় যৌথভাবে অপারেশন পরিচালনা করতে পারে কি না,” বেনারকে বলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ডেস্কের মহাপরিচালক মনজুরুল করিম খান চৌধুরী।
তিনি বলেন, এ ধরনের যৌথ অপারেশনের পরিচালনা করা হলে জঙ্গিরা সীমান্ত অতিক্রম করে পালাতে পারবে না।
“গত শনিবার আমরা সিডিএ-কে ডেকে রাখাইন রাজ্যে চলমান সামরিক অপারেশনের ফলে বাংলাদেশে ব্যাপক হারে মিয়ানমার নাগরিক অনুপ্রবেশের ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগ ও শঙ্কার কথা জানিয়েছি," তিনি বলেন।
রাখাইনের সাম্প্রতিক সংঘর্ষে জড়িত লোকজনকে ‘বাঙালি’ সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করার বিষয়টিতে বাংলাদেশ উদ্বিগ্ন। মিয়ানমারের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স এর কাছে এ বিষয়েও প্রতিবাদ জানানো হয়।
২০১৪ সালে দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী অফিশিয়ালি বাংলাদেশ ‘রোহিঙ্গা’ এবং মিয়ানমার ‘বাঙালি’ শব্দ ব্যবহার করবে না। কিন্তু মিয়ানমার সেই অবস্থান পরিবর্তন করেছে।
মহাপরিচালক বলেন, সিডিএ অং মিন্ট প্রস্তাবটি মিয়ানমার সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে এ ব্যাপারে তার সরকারের অবস্থান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবেন বলে তাকে জানান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন পরিচালক বেনারকে বলেন, বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে মিয়ানমার সরকারকে জানিয়েছে তারা যেন বেসামরিক নিরপরাধ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা না করে।
“আমরা সন্ত্রাসী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযানকে সমর্থন জানাই। তবে বেসামরিক ব্যক্তিদের হতাহতের ঘটনা আমরা কোনোভাবেই সমর্থন করি না,” তিনি বলেন।
গত সপ্তাহে রাখাইন রাজ্যে জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালায়।
গত শুক্রবার এ হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ)’ নামে একটি রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গ্রুপ।
এক সময় এই গ্রুপটি ‘হারাকা আল-ইয়াকিন’ নামে পরিচিত ছিল। যারা গত বছরের অক্টোবরে রাখাইনের পুলিশ পোস্টে হামলা চালায়। ওই হামলায় নয় পুলিশ সদস্য নিহত হয়।
আক্রমণের জবাবে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক নির্বিচার অভিযান শুরু করে।
বার্তা সংস্থা এএফপি সোমবার জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া সহিংসতায় ৮০ জঙ্গিসহ কমপক্ষে একশর বেশি মানুষ রাখাইনে প্রাণ হারিয়েছে।
আশ্রয়ের সন্ধানে হাজারো রোহিঙ্গা
রোহিঙ্গাদের অনেকেই বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারলে ও হাজার-হাজার রোহিঙ্গা এখনো সীমান্ত এলাকায় অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে বলে জানিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধি।
বাংলাদেশে প্রবেশকারী অনেক নর-নারী গুলিবিদ্ধ হয়ে, জখম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আহত দুজন রোহিঙ্গা গতকাল মারা গেছেন।
সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা রোহিঙ্গা প্রবেশ ঠেকাতে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে।
টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে.কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম বেনারকে জানান, “সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭ পর্যন্ত নাফ নদী পার হয়ে উপজেলার সাতটি পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে ৪৭৫ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে । তাদেরকে খাবার, পানি, ওষুধ ও অন্যান্য মানবিক সহযোগিতা দিয়ে নিজ নিজ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।”
এ ছাড়া, আহত অবস্থায় বাংলাদেশে প্রবেশ করা ৩০ জন রোহিঙ্গাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে দুজন রবিবার মারা গেছেন।
তারা হলেন, গুলিবিদ্ধ মো. মুসা (২২) ও হারুন। তারা রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকার বাসিন্দা।
গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বাংলাদেশে প্রবেশকারীরা হলো: নাঈম উল্লাহ, রহমত উল্লাহ, মো. ইমরান, মো. জাফর, নুরুল হক ও মোহাম্মদ উল্লাহ।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সমন্বয় দপ্তর (ওসিএইচএ) সোমবার তাদের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যে জানিয়েছে, রাখাইনে সংঘর্ষের পর ২৪ থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত সেখানকার ৫ হাজার ২শ লোক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার পৌঁছেছে।
এদিকে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর এক কর্মকর্তা সোমবার বেনারকে বলেন রোহিঙ্গারা বিচ্ছিন্নভাবে আসছে। ফলে তাদের আসার সংখ্যাটি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যে নারী, শিশু ও সিনিয়রদের সংখ্যাই বেশি। অনেক শিশুরাই পরিবার বা বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশে আসছে।’
প্রসঙ্গত গত অক্টোবরে সীমান্ত রক্ষীদের চৌকিতে হামলার পরেই রাখাইনের গ্রামে গ্রামে অভিযান চালায় দেশটির সেনাবাহিনী।
সেনা অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে গত অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত আশি হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা। এর বাইরে গত কয়েক দশকে ধরে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এ দেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে দাবি সরকারের।
জাতিসংঘ মহাসচিবের দপ্তরের বিবৃতি
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিরীহ রোহিঙ্গাদের হত্যায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সোমবার এক বিবৃতি দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিবের একজন মুখপাত্র।
মহাসচিবের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তাঁর মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক এর দেওয়া এই বিবৃতিতে বলা হয়, “‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তারক্ষীদের অভিযানে নিরীহ বেসামরিক লোকজনের হতাহতের ঘটনায় মহাসচিব গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।”
এতে বলা হয়, “মহাসচিব কফি আনান এর প্রতিবেদনের সুপারিশমালাকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করেন, এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের (মিয়ানমার) প্রতি জোর দাবি জানান।”
বাংলাদেশ মহানুভবতা দেখিয়ে অসংখ্য রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে স্বীকার করে বিবৃতিতে মহাসচিবের মুখপাত্র বাংলাদেশ সরকারের কাছে সহিংসতায় দেশান্তরি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া অব্যাহত রাখারও আহ্বান জানান।
আমরা জিহাদি নই: এআরএসএ
সোমবার এক টুইটার বার্তায় নিজেদেরকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নয় বলে দাবি করেছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ)। টুইট বার্তায় এআরএসএ রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করছে বলে দাবি করেছে।
এদিকে সোমবার আব্দুল্লা নামে এআরএসএ’র প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মা জুনুনির একজন মুখপাত্রের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় এশিয়া টাইমস এ।
এতে আব্দুল্লা বলেন, “মিয়ানমারকে আমাদের জাতিগত অধিকার পুনর্বহাল করতেই হবে। যতদিন পর্যন্ত আমাদের দাবি মানা না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত প্রতিরোধ চলবে। এর পরেও যদি দাবি মেনে না নেওয়া হয়, তবে আমরা আমাদের দাবি আরেক ধাপ বাড়াব।”
দাবি আরেক ধাপ বাড়নোর কোনো ব্যাখ্যা না দিলেও আব্দুল্লা এশিয়া টাইমসকে বলেন, “আমরা জিহাদি নই। এআরএসএ’র আদর্শ নীতিমালা ও কর্মপদ্ধতি থেকে এটা পরিষ্কার যে, পাকিস্তানি বা অন্যান্য জিহাদিদের সাথে এআরএসএ’র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কোনো মিল নেই। আমরা মূলত অনেকটা মিয়ানমারে সক্রিয় অন্যান্য সশস্ত্র (জাতিগোষ্ঠী কেন্দ্রিক) দলগুলোর মতো।”