প্রতিদিন বাড়ছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, বাড়ছে নৌকা ডুবিতে মৃত্যু
2017.08.31
ঢাকা ও কক্সবাজার

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক সহিংসতার জেরে প্রতিদিনই বাড়ছে রোহিঙ্গাদের ঢল, বাড়ছে পালিয়ে আসার পথে নৌকা ডুবিতে মৃতের সংখ্যা। পাশাপাশি, রাখাইন রাজ্যের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনও এবার প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের সংবাদপত্র।
এদিকে নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ার সপ্তম দিনেও রাখাইনের বিভিন্ন গ্রাম থেকে গুলি শব্দ শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রান্ত থেকে অগ্নিকুণ্ড দেখা যাচ্ছে।
“এপার থেকে দিনের বেলায় মিয়ানমার সীমান্তে আগুনের ধোঁয়া দেখা যায়। আর রাত হলে গুলির শব্দ শুনতে পাই। মাঝে মধ্যে বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়,” বেনারকে বলেন টেকনাফ দমদমিয়া সীমান্তের বাসিন্দা মো. আলী।
ওপারের সীমান্তে আকাশে হেলিকপ্টার উড়তে দেখার কথাও জানান তিনি।
বৃহস্পতিবার টেকনাফ থেকে মংডুর পেরাংপ্রু গ্রামে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখার কথা বেনারকে জানিয়েছেন সেখানে কর্মরত বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক প্রমথেশ শীল।
টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “দিনের বেলায় ওপারে ধোঁয়া দেখা যায়। রাতে মাঝে মধ্যে গুলির শব্দ শুনতে পান সীমান্ত চৌকির সদস্যরা।”
দুই দিনে ২৩ লাশ
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পথে নাফ নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় বৃহস্পতিবার আরও ১৭ রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার হয়েছে, যাদের সবাই নারী ও শিশু। এর আগের দিন একই ঘটনায় আরো দুইজনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল।
বুধবার দিবাগত মধ্যরাতের দিকে ওই নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মোট ১৯টি মরদেহ পাওয়া গেছে। আরও অন্তত ১৫জন নিখোঁজ থাকার কথা জানিয়েছে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া রোহিঙ্গারা।
বৃহস্পতিবার সকালে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ এলাকার মাঝেরপাড়া পয়েন্ট থেকে মৃতদেহগুলো উদ্ধার করার বিষয়টি বেনারকে নিশ্চিত করেন টেকনাফ থানার ওসি মো. মাইনউদ্দিন খান।
তিনি বলেন, “নিহত সকলেই মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে ৯ জন নারী ও ১০ জন শিশু।”
এই ১৯জনসহ গত দু’দিনে নাফ নদী থেকে ২৩ রোহিঙ্গার লাশ পাওয়া গেলো। বাকি চারজন বুধবার পৃথক নৌকাডুবিতে মারা যায়।
এদিকে নিজ দেশের নাগরিকদের লাশ ফেরত নিতে মিয়ানমারের প্রতি আহবান জানিয়েছে বাংলাদেশ।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অণুবিভাগ) মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “ঢাকায় মিয়ানমারের দূতাবাসকে একটি নোট ভারবালের মাধ্যমে তাঁদের দেশের নাগরিকদের লাশ ফেরত নিতে বলা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “লাশগুলো ইতিমধ্যেই পঁচে গেছে। কাল সকালের পর এগুলো হয়ত রাখা সম্ভব হবে না।”
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বেনারকে বলেন, “নৌকা ডুবির ঘটনায় উদ্ধার হওয়া মরদেহগুলো মিয়ানমার ফেরত না নিলে স্থানীয়ভাবে দাফন করা হবে।”
২৭ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা প্রবেশ
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) বুধবার পর্যন্ত ছয় দিনে বাংলাদেশে ১৮ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশের কথা জানায়। তবে গত এক সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে ২৭ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা ঢুকেছে বলে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের কর্মরত জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স।
রয়টার্স জানায়, আরো প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা এখনও দুই দেশের মধ্যবর্তী নো ম্যানস ল্যান্ডে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছে। ফলে বৃহস্পতিবার শেষে এই সংখ্যা ৩০ হাজারে পৌঁছাতে পারে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘ কর্মকর্তারা।
এদিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সীমান্তে কড়া নজরদারির কথা বলে আসছে। রোহিঙ্গা প্রবেশ অব্যাহত থাকার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করছে না বাংলাদেশ। এ পর্যন্ত কতজন রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে তা নিয়েও মন্তব্য করছেন না সরকারে দায়িত্বশীল কেউ।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “অফিসিয়ালি আমরা রোহিঙ্গা প্রবেশ করতে দেওয়ার বিরুদ্ধে। তবে পুরো সীমান্ত জুড়ে পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। সেই ফাঁকে অনেকেই হয়ত প্রবেশ করছে। তা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে মানবিকতাও বড় ব্যাপার হয়ে ওঠে।”
এবার হিন্দুরাও আসছেন
রোহিঙ্গা মুসলিমদের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো রাখাইন রাজ্যে থেকে পালিয়ে ৪১২ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন এবং আরো অনেকে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য জিরো পয়েন্টে অপেক্ষা করছেন বলে বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে জানায় বাংলাদেশের সংবাদপত্র প্রথম আলো।
প্রতিবেদনটি জানায়, রাখাইন রাজ্যের হিন্দু গ্রামগুলোতে মুখোশধারী সশস্ত্র লোকজন হামলা করে ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে বলে পালিয়ে আসা হিন্দুরা জানিয়েছেন। এতে গত কয়েক দিনে অন্তত হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ৮৬ জন নিহত হয়েছেন।
“৪১২ হিন্দুর বেশির ভাগই নারী-শিশু”, প্রথম আলোকে জানান উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের।
এক হাজার রোহিঙ্গা আটক
এদিকে বৃহস্পতিবার ভোর থেকে বিকেল সাড়ে ৩ টা পর্যন্ত টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে এক হাজার রোহিঙ্গাকে আটক করেছে বিজিবি। তাদের মানবিক সহযোগিতা দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত দেওয়া হবে জানিয়েছেন লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম।
তবে এই কড়াকড়ির মধ্যেও রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে।
“শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত আনুমানিক ৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে,” বেনারকে জানিয়েছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য নুর আমিন।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে।