এবার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করল মিয়ানমার
2017.09.01
ঢাকা ও কক্সবাজার

প্রতিদিন মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের ঢল বাড়তে থাকা অবস্থায় একাধিকবার মিয়ানমার এর হেলিকপ্টার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করায় শুক্রবার দেশটির কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।
শুক্রবার পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ সূত্র। এবার এই অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে রয়েছেন পাঁচ শর বেশি হিন্দু রোহিঙ্গাও। পাশপাশি মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার সময় নাফ নদীতে নৌকা ডুবিতে শুক্রবার পর্যন্ত মৃত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৪৯ জনে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
মিয়ানমার এর হেলিকপ্টার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করায় ঢাকার মিয়ানমার দূতাবাসের কাছে শুক্রবার ডিপ্লোমেটিক নোট এর মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো হয় বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এতে শুক্রবার ছাড়াও গত মাসের ২৭ ও ২৮ তারিখ মিয়ানমারের হেলিকপ্টার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে বলে জানানো হয়।
এ পর্যন্ত উদ্ধার ৪৯ লাশ
টেকনাফ মডেল থানার ওসি মো. মাইনউদ্দিন খান বেনারকে জানান, শুক্রবার সকাল থেকে রাত ৮ পর্যন্ত নাফ নদীর তীরে ভেসে আসা ২৬ রোহিঙ্গার লাশ স্থানীয়দের সহযোগিতায় উদ্ধার করা হয়েছে।
এ নিয়ে গত তিন দিনে নাফ নদী থেকে ৪৯ জন রোহিঙ্গার মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
ভেসে আসা লাশগুলোর শরীরে বিভিন্ন জখম রয়েছে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ী নুর আলম মনে করেন, এগুলো রাখাইনে সহিংসতার ঘটনায় হত্যার শিকার হওয়া ব্যক্তিদেরই মৃতদেহ। সেখানে হত্যার পর তাদের নাফ নদীতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
এর আগে বুধ ও বৃহস্পতিবার শাহপরীর দ্বীপে সাগর উপকূল থেকে ২৩ রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
এদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষে গত ২৪ আগস্টের পর থেকে সহিংসতায় রাখাইনে মোট ৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। মৃতদের মধ্যে ৩৭০ জন রোহিঙ্গা বিদ্রোহী, নিরাপত্তা বাহিনীর ১৩, দুইজন সরকারি কর্মকর্তা ও ১৪ জন বেসামরিক লোক রয়েছেন বলে বিবৃতিটি জানায়।
দুই দিনেই অর্ধ লক্ষ রোহিঙ্গার প্রবেশ
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলেছেন, বৃহস্পতি থেকে শুক্রবার এই দু’দিনেই প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। তাঁদের মতে, গত আট দিনে এ সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার।
অবশ্য কক্সবাজারে কর্মরত জাতিসংঘের কর্মকর্তা এ সংখ্যা ৩৮ হাজারের বেশি বলে জানিয়েছেন।
“এই মুহূর্তে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের সঠিক সংখ্যা ও পরিচয় নিশ্চিত করা খুবই কঠিন। কারণ তারা বিভিন্ন পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বিচ্ছন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছেন,” শুক্রবার বেনারকে ইমেইলে জানান জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর মুখপাত্র দুনিয়া আসলাম খান।
তবে বাংলাদেশের প্রসাশনের পক্ষ থেকে কেউ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “শুক্রবার ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত সাড়ে ৪ হাজার রোহিঙ্গাকে আটক করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।”
সরেজমিনে শাহপরীর দ্বীপ
শুক্রবার সকালে শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিম পাড়ার সৈকতে দেখা যায়, অসংখ্য রোহিঙ্গা নৌকা থেকে নেমে টেকনাফ শহরের দিকে রওনা দিয়েছেন। তাঁদেরেই একজন আমেনা খাতুন (৬০)। আলাপকালে তিনি বেনারকে জানান, রাখাইনে গত দুই দিন ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনা ও পুলিশের নির্যাতন ব্যাপক ভাবে বেড়েছে। এ কারণে গত কয়েকদিনের তুলনায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা বেড়েছে।
তিনি শুক্রবার ভোরে রাখাইন রাজ্যের ফাদনচা গ্রাম থেকে নৌকায় করে শাহপরীর দ্বীপে পৌঁছেছেন।
এসেছেন ৫শ’র বেশি হিন্দু রোহিঙ্গা
মিয়ানমারে চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতিতে হিন্দুরাও আক্রান্ত হয়ে মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছেন। মুসলিমদের পাশাপাশি হিন্দুদেরও হত্যা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
শুক্রবার সকালে উখিয়া উপজেলার কুতুপালং হিন্দুপাড়ায় আশ্রয় নেওয়া ৮টি হিন্দু রোহিঙ্গা পরিবারের ১৬ জন নারী ও শিশুর সঙ্গে কথা বলেন বেনার নিউজ প্রতিনিধি।
এসময় তাঁরা জানান, গত সোমবার রাখাইন থেকে চার শতাধিক ও বুধবার আরও ৫০ জন হিন্দু নারী-পুরুষ ও শিশু বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। তাঁরা কুতুপালং হিন্দুপাড়ার পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্র, একটি মুরগির খামারসহ আশেপাশের গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন।
মিয়ানমার থেকে আসা স্বপন শীল জানান, তাঁর বাড়ি রাখাইনের বলি বাজার গ্রামে। গত শনিবার রাতে তার গ্রামের হিন্দুদের ১০টি বাড়িঘরে আগুনে জ্বালিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এসময় আক্রমণকারীরা শুধু রাখাইন চেহারা ছাড়া অন্যদের গুলি করতে থাকে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। প্রাণ ভয়ে তিনি কয়েকদিন পাহাড়ে লুকিয়ে ছিলেন।
তবে আক্রমণকারী কারা তা তিনি বলতে পারেন নি।
অন্য একজন শরণার্থী গঙ্গা বালা জানান, পুরো শরীর কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা সশস্ত্র লোকজন এসে শনিবার রাতে তাদের বাড়ি থেকে তার স্বামী পবন চন্দ্রকে ধরে নিয়ে যায়। ঘরে আগুন লাগানোর পাশাপাশি স্বর্ণ লুট করে তারা। কম বয়স্ক নারীদের আলাদা করে বৃদ্ধ নারীসহ পুরুষদের জবাই করে হত্যা করা হয়।
আলাপকালে এসব রেহিাঙ্গারা জানান, শতাধিক হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে। অধিকাংশই রাখাইনের মংডুর ফকিরাবাজার ও বলি বাজার গ্রামের বাসিন্দা।
উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের বলেন, সাড়ে ৪ শতাধিক হিন্দু পরিবারের লোক এপারে প্রবেশে করেছে। এদের বেশির ভাগই নারী-শিশু। তাঁদেরকে খাবারসহ নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে।
হিন্দু পাড়ায় আশ্রয় নেওয়া এসব রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তাসহ যাতে কোনো সমস্যা না হয় সে বিষয়ে স্থানীয় পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
খোঁজ নিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট
মিয়ামারে চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে টেলিফোন করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ান। এসময় তিনি রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপ সমর্থন করেন বলে শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
“বৃহস্পতিবার রাতে ফোনালাপে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান রাখাইন রাজ্যে বিরাজমান পরিস্থিতি ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর মিয়ানমারের চলমান নিপীড়ন ও মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের আলোচনায় রোহিঙ্গা সমস্যা উপস্থাপনে তুরস্কের প্রয়াস অব্যাহত রাখার আশ্বাসও দেন তিনি,” বিবৃতিতে বলা হয়।
আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে সহিংসতার বিবরণ
এদিকে রাখাইন রাজ্যের ১৭টি গ্রাম থেকে নতুন আসা ২৪ জন সহিংসতার সাক্ষী রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটস।
প্রতিবেদনটিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতি রাখাইনের বেসামরিক লোকজনের ওপর সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনটি জানায়, মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনী ও সশস্ত্র স্থানীয় বাসিন্দারা সেখানে শিশু ও নারীসহ রোহিঙ্গাদের ওপর ‘পরিকল্পিত গণহত্যায়’ নিয়োজিত এবং গত সপ্তায় তারা সেখানে অসংখ্য রোহিঙ্গা গ্রামও জ্বালিয়ে দিয়েছে।
“পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ, সেখানে গণহত্যার মতো অপরাধ চলছেই। শিঘ্রই বেসামরিক সরকার ও সেনাবাহিনীর উচিত নিজেদের ক্ষমতা দিয়ে সেখানে আরো আক্রমণ বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া,” বলেন ফর্টিফাই রাইটস এর প্রধান নির্বাহী ম্যাথিউ স্মিথ।
“অনেককে জবাই করেছে, কাউকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাশের গ্রামের লোকজন যখন আমাদের গ্রামের মানুষকে জবাই করছিল তখন আমরা ঘরের ভেতর লুকিয়ে ছিলাম। কিন্তু এসব দেখে বাড়ির পেছন দিকে বের হয়ে পালিয়ে আসি,” ২৭ বছরের রোহিঙ্গা শরণার্থী সুলতান আহমদকে উদ্ধৃত করে জানায় প্রতিবেদনটি।
তবে ফর্টিফাই রাইটসের প্রতিবেদনে বেসামরিক লোকজনকে হত্যার জন্য আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি যা আগে আল ইয়াকিন নামে পরিচিত ছিল, সেই বিদ্রোহী সংগঠনটিকেও দায় দেওয়া হয়েছে।
“বিদ্রোহীরা পুরুষদের আসতে দিতে চায় না, তারা শুধু নারী ও শিশুদের সীমান্ত পার হতে দেয়। তারা বলে যে পুরুষরা যদি সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করে তবে গুলি করবে,” ফর্টিফাই রাইটসকে টেলিফোনে জানান একজন রোহিঙ্গা।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ওয়াশিংটন ডিসি থেকে রনি টলডেনস ও ইমরান ভিটাচি।