নির্বাচনের আগে মিয়ানমারে ভোটাধিকার দাবি রোহিঙ্গাদের
2020.09.03
ঢাকা ও কক্সবাজার

মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচনের আগে নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার ফিরে পেতে চান রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। দেশটির নির্বাচন কমিশনের কাছে লেখা এক চিঠিতে বৃহস্পতিবার এই দাবি জানিয়েছেন জাতিগত নিধনের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর নেতারা।
“ইউনিয়ন নির্বাচন কমিশনের (ইউইসি) উচিত সাধারণ নির্বাচনে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া,” বলা হয় মিয়ানমারের নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান হ্লা থেইনের কাছে লেখা ওই চিঠিতে।
চিঠি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) ভাইস চেয়ারম্যান আবদুর রহিম।
“বাংলাদেশের কক্সবাজারে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ১৪টি সংগঠনের পক্ষ থেকে যৌথভাবে এই দাবি জানানো হয়েছে,” বেনারকে বলেন তিনি।
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মিয়ামারের রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ও নেদারল্যান্ডসের হেগের আন্তর্জাতিক আদালত বিচারকদের পাশাপাশি দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূতেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে চিঠিতে।
“মিয়ানমার সরকারের উচিত নির্বাচনের আগে আমাদের নাগরিকত্বের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া এবং আমাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ ও সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অধিকারকে সমর্থন করা,” বলেছে সংগঠনগুলো।
আগামী ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে। রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার পর দেশটিতে এটিই প্রথম নির্বাচন।
এদিকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের এই দাবিকে গুরুত্ব দেবার সম্ভাবনা না থাকলেও “বিষয়টি ইতিবাচক” বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন।
তাঁর মতে, নিজ দেশের জাতীয় নির্বাচনের আগে রোহিঙ্গারা নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় খোলা চিঠির মাধ্যমে যেভাবে তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি জানিয়েছেন “তা ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল” হয়ে থাকবে।
এ ব্যাপারে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে ইউইসির সদস্য ও মুখপাত্র মুইন্ট নাইং-কে ইমেইল করেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
“অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচনে আমরা যাতে অংশ নিতে পারি সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহল চাপ প্রয়োগ করবে, এমনটাই আমরা আশা করছি,” বেনারকে বলেন রোহিঙ্গা নেতা আব্দুর রহিম।
“যদিও ইউইসি ও মিয়ানমার সরকার এরই মধ্যে সাফ জানিয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গারা নির্বাচনে অংশ নিতে বা ভোট দিতে পারবে না,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এটা খুবই দুঃখজনক।”
“২০১০ সালের নির্বাচনেও আমরা অংশ নিয়েছি, ভোট দিয়েছি। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় রেজিস্ট্রেশন কার্ড (এনআরসি) এবং পরবর্তীতে সরকারের দেওয়া হোয়াইট কার্ড দেখিয়ে ভোট দিতে পেরেছি আমরা,” বলেন আব্দুর রহিম।
তবে ২০১৫ সালের নির্বাচনে রোহিঙ্গা বা মুসলিমদের কোনো দল থেকে প্রার্থী হতে দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন শরণার্থীরা।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে শূন্য রেখায় আটকে থাকা রোহিঙ্গাদের নেতা দিল মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “এবারও রোহিঙ্গারা যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সেজন্য আগে থেকেই নীল নকশা তৈরি করে রেখেছে বর্মীরা।”
ফর্টিফাই রাইটসের বিবৃতি
রোহিঙ্গাদের খোলা চিঠির কথা উল্লেখ করে বুধবারই মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটস বলেছে, মিয়ানমারের সরকারের উচিত নভেম্বরের নির্বাচনে বাংলাদেশে অবস্থানকারী শরণার্থীসহ প্রাপ্তবয়স্ক সব রোহিঙ্গার ভোটের অধিকার এবং সুযোগ নিশ্চিত করা।
“সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সব রোহিঙ্গাদের তাঁদের দেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও ভোট দেওয়ার অধিকার থাকা উচিত,” বিবৃতিতে বলেন ফরটিফাই রাইটসের আঞ্চলিক পরিচালক ইসমাইল ওলফ।
নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরদিন গত ২ জুলাই ইউইসি ঘোষণা করে, বিদেশে বাস করা মিয়ানমারের নাগরিকরা এ বছরের সাধারণ নির্বাচনে অগ্রিম ভোট দিতে পারবেন। ২০১০ ও ২০১৫ সালের নির্বাচনেও প্রবাসীদের ভোটদানের ব্যবস্থা করেছিল মিয়ানমার।
“কিন্তু রোহিঙ্গাদের নাগরিক, এমনকি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবেও স্বীকার করছে না মিয়ানমার। তারা দাবি করে আসছে, রোহিঙ্গারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী,” বলেন ড. দেলোয়ার।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার প্রার্থীতা প্রত্যাখ্যান করার কথা উল্লেখ করে রোহিঙ্গা নেতাদের ওই চিঠিতে ওইসব সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের আহবান জানানো হয়।
এর আগে ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের দাবির সাথে একাত্মতা জানিয়ে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়, “নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে আনার সুযোগ দিয়েছে।”
বিশ্লেষক ও রোহিঙ্গা নেতাদের দাবি, ১৯৮২ সালে সরকারিভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণ করার পর তাঁরা একটি রাষ্ট্রহীন গোষ্ঠীতে পরিণত হন।
মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুসারে ১৮২৪ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শুরুর আগে যাদের পূর্বপুরুষেরা সেখানে ছিলেন, বর্তমানে তারাই শুধু নাগরিকত্ব পাচ্ছেন।
এছাড়া দেশের ১৩৫টি নৃগোষ্ঠীকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হলেও এর মধ্যে মধ্যে নৃগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
“তখন থেকেই রোহিঙ্গারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের চেষ্টা করছে। এ জাতীয় দাবির কারণেই বারবার তাদের বিতাড়নের চেষ্টা করা হয়েছে,” বলেন ড. দেলোয়ার।
“রোহিঙ্গাদের নূন্যতম স্বীকৃতি দিয়ে তাঁদের ফিরিয়ে নিতেও প্রস্তুত নয় দেশটি,” বলেন তিনি।
সর্বশেষ ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে মিয়ানমার আর্মির নেতৃত্বে রোহিঙ্গাদের ওপর গণধর্ষণ-গণহত্যা চলাকালে নতুন করে আট লাখেরও বেশি নারী-পুরুষ ও শিশু পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন।
এরপরও ছয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে আছেন, যারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে দাবি করেছে ফর্টিফাই রাইটস।
করোনাভাইরাস মহামারি এবং নভেম্বরে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন-এই দুই কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনাও এগোচ্ছে না বলে গত মাসে বেনারকে জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন।
করোনায় আক্রান্ত ১২৩ রোহিঙ্গা
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১২৩ জন রোহিঙ্গা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সমন্বকারী ডা. আবু তোহা।
সংক্রমণে এখন পর্যন্ত মোট ছয় রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়ছে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তিন লাখ ১৯ হাজার ৬৮৬ জন। আর মৃত্যু হয়েছে চার হাজার ৩৮৩ জনের।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট দুই কোটি ৬১ লাখ ১৮ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন আট লাখ ৬৪ হাজারের বেশি।