রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নাগরিকত্ব দেবার দাবি মানবাধিকার সংগঠনের

পুলক ঘটক ও জেসমিন পাপড়ি
2019.09.04
ঢাকা
190904_Rohingya_620.JPG কক্সবাজারের একটি শরণার্থীশিবিরে ত্রাণ সংগ্রহের জন্য লাইনে অপেক্ষমাণ রোহিঙ্গারা। ২৩ জানুয়ারি ২০১৯।
[কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ]

মিয়ানমারে বসবাসরত এবং বাংলাদেশের শরণার্থীশিবিরে থাকা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পুনর্বহালের জন্য মিয়ানমারের প্রতি দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ফোর্টিফাই রাইটস।

মঙ্গলবার থাইল্যান্ডের ব্যাংককে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ম্যাথু স্মিথ বলেন, “মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ‘বিদেশি’ আখ্যা দিয়ে যে জাতীয় শনাক্তকরণ কার্ড (এনভিসি) বিতরণ করছে তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।”

‘গণহত্যার হাতিয়ার: জাতীয় শনাক্তকরণ কার্ড এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।

এদিকে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গা নেতারা বলেছেন, নাগরিকত্ব ছাড়া তাঁরা মিয়ানমারে ফিরবেন না।

লেদা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা সায়েদ আলম বেনারকে বলেন, “এনভিসি কার্ড নয় সরাসরি নাগরিকত্ব প্রদান, ভিটে-বাড়ি ও জমি-জমা ফেরত, কারাগারে বন্দী রোহিঙ্গাদের মুক্তি, হত্যা ও ধর্ষণের বিচারসহ বিভিন্ন শর্ত পূরণ না হলে আমরা ফিরে যাব না।”

ওই রোহিঙ্গা নেতা বলেন, “আমাদের বাপ, দাদারা মিয়ানমারের নাগরিক। আমরা কেন এনভিসি কার্ড নিতে মিয়ানমারে যাব?”

“এ ধরনের কার্ড রোহিঙ্গাদের জন্য অবমাননাকর,” মন্তব্য করেন ম্যাথু স্মিথ বলেন, “এ ধরনের কার্ড কোনো জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই প্রজ্ঞার পরিচায়ক হতে পারে না।”

মিয়ানমারে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শতবর্ষ যাবত বংশ পরম্পরায় মিয়ানমারে বসবাস করলেও দেশটির সরকার তাঁদের ‘অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী’ আখ্যা দিয়ে এ ধরনের কার্ড গ্রহণ ও ব্যবহার করতে বাধ্য করছে। নইলে তাঁদের জীবিকার সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়।”

মানবাধিকার সংস্থাটি জানায়, মিয়ানমারে “রোহিঙ্গা গ্রামবাসীদের বন্দুকের নলের মুখে শনাক্তকরণ কার্ড গ্রহণে বাধ্য করা হয়। কেউ আপত্তি জানালে তাঁদের মারধর ও নির্যাতন করা হয়। এমনকি যারা এই কার্ড গ্রহণ করে তাঁদেরও মিয়ানমারে চলাফেরার স্বাধীনতা সীমিত করে দেওয়া হয়।”

“মিয়ানমার এখনো প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গাকে নির্জন গ্রামাঞ্চলে এবং রাখাইন প্রদেশের ২৪টি ক্যাম্পে দৈন্যদশায় আটকে রেখেছে। মিয়ানমারে বিভিন্ন দাতা সংস্থায় কর্মরত রোহিঙ্গাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে তারা শনাক্তকরণ কার্ড গ্রহণ না করলে চাকরি থাকবে না,” জানিয়েছে ফোর্টিফাইড রাইটস।

১৯৮২ সালে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন পাশ করার পর থেকে মিয়ানমার সরকার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বৈধ জাতিগত পরিচয় অস্বীকার করছে। তাঁদের নাগরিকত্ব এবং স্বাস্থ্য সেবাসহ অন্যান্য অধিকার অস্বীকার করা হচ্ছে।

তবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেবার বিষয়টি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে গতমাসে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আনাদোলুর সাথে এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।

বাংলাদেশ শুধু চায়, অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও স্থায়ী প্রত্যাবাসন,” বেনারকে বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা।

এনভিসি রোহিঙ্গাদের জন্য নয়

জাতিগত রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে ইউরোপীয় রোহিঙ্গা পরিষদের আম্বিয়া পারভিন মঙ্গলবার ব্যাংককে বলেন, “এই শনাক্তকরণ কার্ড আমাদের জন্য নয়। আমরা যে মিয়ানমারের বৈধ জাতিসত্তা তার স্বপক্ষে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ আমাদের কাছে আছে। এর আগে আমাদের পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্ব ছিল।”

তিনি বলেন, “আমরা এনভিসি গ্রহণ করলে তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পারে। এটা গ্রহণ করলে আমাদের স্বীকার করা হলো যে আমরা বিদেশি এবং কার্ডের ওপর আমাদের নিজেদেরকেই লিখতে হচ্ছে, আমরা বিদেশি কিংবা বাঙালি।”

ব্যাংককে মিয়ানমারের আন্তঃধর্মীয় নেতা খিন মঙ মিন্ট বলেন, “মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য এখন সুষ্পষ্ট। তারা রাখাইনে এই মানুষগুলোর দায় থেকে মুক্ত হতে চায় এবং তাঁদেরকে নাগরিক হিসেবে ফিরিয়ে নিতে চায় না।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আগে মিয়ানমার সরকারকে ২০১২ সালের প্রথম দফার আক্রমণে বাস্তুচ্যুত হয়ে রাখাইনের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত এক লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গাকে তাঁদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে হবে।”

“এসব মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে তাঁদের বাড়িঘরে ফেরার বন্দোবস্ত করুন। সেটা করলে বাংলাদেশে অবস্থানরত ৮ থেকে ১১ লাখ মানুষ স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে আসবে,” বলেন খিন মঙ মিন্ট।

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের সীমান্ত চৌকিতে জঙ্গি হামলার প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নির্দয় অভিযান শুরু করলে সাত লাখ ৪০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার শরণার্থীশিবিরগুলোতে অবস্থান করছে।

সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে

ফোর্টিফাই রাইটস তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, জাতীয় শনাক্তকরণ কার্ড প্রদান এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে এবং রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিক হিসেবে সমঅধিকার দিতে হবে।

তারা জানায়, “মিয়ানমার, বাংলাদেশ এবং বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অর্থবহ আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিয়ে বিষয়গুলোর সুরাহা করা প্রয়োজন।”

এটা না করা পর্যন্ত মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার জন্য জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা এবং বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনটি।

এদিকে “আমরা রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান চাই। আর তা শুধু সম্ভব মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে,” মন্তব্য করে বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বেনারকে বলেন, তবে কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে ফেরত পাঠানো হবে না। প্রত্যাবাসন হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সাথে।”

প্রতিবেদন তৈরিতে বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়ার সহায়তা নেয়া হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।