ভাসানচর যাচ্ছেন তিন নারীসহ প্রায় অর্ধশত রোহিঙ্গা নেতা
2020.09.04
ঢাকা ও কক্সবাজার

কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে তৈরি করা আবাসন ব্যবস্থা বসবাসের উপযোগী কি না তা দেখতে যাচ্ছেন রোহিঙ্গা নেতারা।
ভাসানচরে যাবার জন্য তিন নারীসহ ৪৭ জন রোহিঙ্গা নেতা শুক্রবারেই এসে পৌঁছেছেন উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে।
“সবকিছু ঠিক থাকলে শনিবার তাঁদের সেখানে (ভাসানচর) নিয়ে যাওয়া হবে,” শুক্রবার বেনারকে বলেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মাহবুব আলম তালুকদার।
জাতিসংঘসহ শরণার্থীদের মানবিক সেবাদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিরোধিতা সত্ত্বেও কমপক্ষে এক লাখ শরণার্থীকে ওই দ্বীপে স্থানান্তর করার লক্ষ্যে চলমান সরকারি প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এই উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ভাসানচর যাবেন। সরকারের আশা, রোহিঙ্গা নেতারা দেখে এসে অন্যদের বোঝালে ভাসানচর যেতে রাজি হবেন শরণার্থীরা।
তবে এই দলের সাথে রোহিঙ্গাদের সহায়তাকারী জাতিসংঘের কোনো সংস্থার প্রতিনিধি বা গণমাধ্যমর্কীরা থাকছেন না।
“এ ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। আমাদের সাথে কোনো আলোচনা হয়নি,” বেনারকে বলেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ঢাকাস্থ কার্যালয়ের মুখপাত্র মোস্তফা সাজ্জাদ হোসেন।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. জালাল উদ্দিন শিকদারের মতে, যাদের সহায়তায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভরণপোষণ দেওয়া হচ্ছে, তাদের বিষয়টি জানানো উচিত ছিল।
“যদিও রোহিঙ্গা নেতারা ভাসানচর থেকে সন্তুষ্ট চিত্তে ফিরে সাধারণ শরণার্থীদের সেখানে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে পারলে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর আর কিছুই বলার থাকবে না। তবে এতগুলো লোককে সেখানে নিয়ে সরকার নিজের পয়সা দিয়ে খাওয়াতে পারবে না,” বেনারকে বলেন তিনি।
তবে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাবার পর দাতারা সহায়তা না করলেও “প্রক্রিয়াটি চালিয়ে নেওয়া যাবে,” জানিয়ে আরআরআরসি বেনারকে বলেন “সরকারের সেই সামর্থ্য আছে।”
শনিবার গিয়ে ফিরবেন মঙ্গলবার
ভাসানচরের বসবাস উপযোগিতা দেখতে রোহিঙ্গা নেতাদের আগস্টের শুরুতে সেখানে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে তা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর রামু-১০ পদাতিক ডিভিশনের মুখপাত্র মেজর ওমর ফারুক।
রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা শুক্রবার রাতে উখিয়ায় থাকবেন, সেখান থেকে শনিবার ভোরে তাঁদের সড়কপথে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়া হবে জানিয়ে মেজর ফারুক বলেন, “সেখান থেকে জাহাজে করে তাঁদেরকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হবে।”
ভাসানচরে রোহিঙ্গা নেতাদের সফরের কাজটি সেনাবাহিনীর সহায়তায় আরআরআরসি করছে বলে বেনারকে জানান ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক ও নৌবাহিনীর কমোডর এ এ মামুন চৌধুরী।
টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থীশিবিরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে রোহিঙ্গা নেতারা তিন চারদিনের প্রস্তুতি নিয়ে ক্যাম্প ইনচার্জের (সিআইসি) কার্যালয়ে পৌঁছানোর পর সেনা প্রহরায় মাইক্রোবাসে করে উখিয়া রওয়ানা দিয়েছেন।
“শুক্রবার রাতে তাঁদের উখিয়ায় কুতুপালংয়ের ট্রানজিট পয়েন্ট থাকার কথা রয়েছে। সেখান থেকে শনিবার সকালে তাঁরা ভাসানচরের উদ্দ্যেশে রওনা করবেন,” বেনারকে বলেন জাদিমুরা ও শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (সিআইসি) মোহাম্মদ খালিদ হোসেন।
প্রতিনিধিরা উখিয়ায় পৌঁছানোর পর শুক্রবার রাতেই তাঁদের সাথে দেখা করে আরআরআরসি মাহবুব আলম তালুকদার ভাসানচরের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
প্রতিনিধিরা আগামী মঙ্গলবার শিবিরে ফিরে আসার কথা রয়েছে বলে বেনারকে জানান ভাসানচরগামী দলের রোহিঙ্গা সদস্যরা।
আগেই সব প্রতিনিধির করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হয়েছে জানিয়ে টেকনাফ লেদা শরণার্থীশিবিরের ডেভেলপমেন্ট কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলম বেনারকে জানান, শুক্রবার রওয়ানা দেবার আগে তাঁদের সবার সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষাও হয়েছে।
“পরিদর্শনের পর রোহিঙ্গা নেতারা ভাসানচরে যাওয়ার স্বপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে,” গত জুলাইর শেষ দিকে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের তালিকা তৈরির সময় বেনারকে বলেছিলেন শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন-১৬) পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ হেমায়েতুল ইসলাম।
“ভাসানচর যদি বসবাসের উপযুক্ত হয় তবে অবশ্যই রোহিঙ্গারা সেখানে যাবে। আমরা স্বচক্ষে দেখে এলে সবাইকে বোঝাতে পারব,” জুলাইতে বেনারকে বলেন টেকনাফের শালবন রোহিঙ্গা শিবিরের হেড মাঝি মো. নুর।
কেমন আছেন ভাসানচরের রোহিঙ্গারা?
বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা তিন শতাধিক রোহিঙ্গাকে গত মে মাসে ভাসানচরে নিয়ে যায় সরকার।
জুলাইয়ে ইউএনএইচসিআর-এর কক্সবাজার কার্যালয়ের মুখপাত্র লুইস ডোনোভান বেনারকে বলেছিলেন, ওই শরণার্থীদের জন্য সেখানে জাতিসংঘের প্রবেশাধিকার এখন খুবই জরুরি।
ভাসানচরে থাকা রোহিঙ্গাদের সাথে তাঁদের স্বজনেরাও যোগাযোগ করতে পারছেন না জানিয়ে ইউএনএইচসিআর এর মুখপাত্র সাজ্জাদ হোসেন শুক্রবার বেনারকে বলেন, “এখনো আমরা সরকারের নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছি।”
ভাসানচরে থাকা রোহিঙ্গাদের স্বজনদের বরাত দিয়ে গত জুলাইতে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, সেখানে রোহিঙ্গাদের চলাচলের স্বাধীনতা, খাদ্য বা চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। এমনকি নিরাপদ খাবার পানিরও তীব্র সংকটে পড়েছেন তাঁরা।
কক্সবাজারে ওই রোহিঙ্গাদের কয়েকজন পরিবার সদস্য হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জানিয়েছেন, ভাসানচরে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের মারধর ও তাঁদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে।
তবে ভাসানচরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক কমোডর মামুন বেনারকে বলেন, “এখানে থাকা ৩০৬ রোহিঙ্গা খুবই ভালো আছে। তারা আরাম করে খাচ্ছে-ঘুমাচ্ছে।”
“এখনো তাঁদের বেসামরিক প্রশাসনের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। আমরাই (নৌ বাহিনী) তাঁদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করছি” বলেন তিনি।
এদিকে প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ার পরই বেসামরিক প্রশাসনের কাছে হস্তান্তরর প্রক্রিয়াটি শুরু হবে বলে বেনারকে জানান নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খান।
“সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশ পেলেই আমরা ওই রোহিঙ্গাসহ পুরো প্রকল্পটি বুঝে নেবো,” বলেন আরআরআরসি।
ভাসানচরকে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ আবাস হিসেবে গড়ে তুলতে অন্তত ৫৫টি বিষয় সুরাহা করা উচিত বলে আগে মতামত দিয়েছিল জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো। যার মধ্যে রয়েছে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগে সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকা।
রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার।
সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়া জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ১৯ ফুট উঁচু বাঁধ এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে ভাসানচরে।