রোহিঙ্গাদের জন্য নতুন শরণার্থী শিবির করছে সরকার
2017.09.05
ঢাকা ও কক্সবাজার

গত দশ দিনে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সহিংসতায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় সোয়া লাখে পৌঁছে যাবার প্রেক্ষিতে তাদের জন্য নতুন শরণার্থী শিবির তৈরি করছে সরকার।
এদিকে রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে ইন্দোনেশিয়া প্রস্তুত রয়েছে বলে মঙ্গলবার জানিয়েছেন দেশটির ঢাকা সফররত পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রবার্ট ওয়াটকিনস এক ই-মেইলের মাধ্যমে মঙ্গলবার বেনারকে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য তার সংস্থা ১৮ মিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড গত সোমবার দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে জোর করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে এমন খবর প্রকাশের একদিন পর ইউরোপীয় কমিশনের মানবিক সহায়তা ও সংকট ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কমিশনার ক্রিসটোস স্টাইলিয়ানিডেস মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জোর করে ফেরত পাঠানো যাবে না।
সহযোগিতায় প্রস্তুত ইন্দোনেশিয়া
বাংলাদেশ সফররত ইন্দোনেশীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি মঙ্গলবার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। এরপর সন্ধ্যায় স্থানীয় একটি হোটেলে এক সংক্ষিপ্ত সংবাদ ব্রিফিংয়ে মারসুদি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য যে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা নিরসনে সহযোগিতা করতে তাঁর দেশ প্রস্তুত আছে। ইন্দোনেশিয়া আশা করে রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক বিপর্যয়কর বর্তমান পরিস্থিতির অবসান হবে।
এর আগে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গেও বৈঠক করেন। মারসুদি কয়েক মিনিটেই ব্রিফিং শেষ করেন। তিনি সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি। ব্রিফিংয়ের সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (বহির্বিশ্ব) এবং আরও কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে বাংলাদেশ সফরের আগে মারসুদি সোমবার মিয়ানমার সফর করে দেশটির নেতৃ আং সান সু চির সাথে এক বৈঠকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান প্রক্রিয়া শুরুর জন্য চার দফা প্রস্তাব রাখেন বলে এক টুইট বার্তায় জানায় দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মিয়ানমারের কাছে তাঁর প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে, রাখাইন রাজ্যে নিরপত্তা ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, সহিংসতা বন্ধ, সবার সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও মানবিক সহযোগিতার সুযোগ উন্মুক্ত করা।
“এই চারটি বিষয় খুবই দ্রততার সাথে নিশ্চিত করতে হবে, যাতে নিরাপত্তা ও মানবিক সংকট পরিস্থিতির আরো অবনতি না হয়,” ওই বৈঠকে বলেন মারসুদি।
শরণার্থী শিবির তৈরি করছে বাংলাদেশ
সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) টেকনাফ অঞ্চলের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফুল ইসলাম মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, টেকনাফের পটুবুনিয়ার তিনটি পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের জন্য নতুন ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়েছে।
১৯৯২ সালের পর এই প্রথমবারের মতো সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
“সোমবার থেকে আমরা পটুবুনিয়ার তিনটি পাহাড়ে নতুন করে প্রবেশ করা মানুষদের জন্য ক্যাম্প বানিয়েছি। ইতিমধ্যে ২০ হাজারর বেশি মানুষ সেখানে অবস্থান করছে। এখানে প্রায় ৪৫ হাজারের মতো মানুষ থাকতে পারবে,” আরিফুল ইসলাম বলেন।
কক্সবাজার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও প্রশাসনের মুখপাত্র খালেদ মাহমুদ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “যারা ইতিমধ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে আমরা তাদের সবাইকে জড়ো করে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রাখার চেষ্টা করছি, যাতে তারা অন্য কোথাও চলে না যায়।”
তিনি বলেন উখিয়ার বালুখালি এলাকায় তাদের রাখার জন্য জমি খোঁজা হচ্ছে।
১০ দিনে প্রায় সোয়া লক্ষ অনুপ্রবেশ
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রবার্ট ওয়াটকিনস মঙ্গলবার বেনারকে জানিয়েছেন, ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মঙ্গলবার পর্যন্ত এক লাখ ২৩ হাজার ছয়শো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
"আমরা ১৮ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা কামনা করেছি," বলেন ওয়াটকিনস। তিনি আরো বলেন, জাতিসংঘের বিভিন্ন এনজিও, আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ও রেড ক্রস/ক্রিসেন্টের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র দুনিয়া আসলাম খান মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে প্রবেশ করা রোহিঙ্গারা নাজুক অবস্থায় আছে।
"তাদের অধিকাংশই হাতের কাছে যা পেয়েছে তা নিয়ে দিনের পর দিন জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে, নদী, পাহাড় পার হয়ে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারা ক্ষুধার্ত, দুর্বল ও অসুস্থ," তিনি বলেন।
দুনিয়া খান বলেন, ইতিমধ্যে ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা কুতুপালং ও নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। অন্যান্যরা স্থানীয় গ্রামে ও অন্যান্য স্থানে অবস্থান করছে।
আরও অসংখ্য রোহিঙ্গা সীমান্তে অপেক্ষা করছে, তিনি বলেন।
শরণার্থী পরিবাররা নবাগতদের বিভিন্ন শরণার্থী স্কুল, কমিউনিটি সেন্টার, মাদ্রাসা ও অন্যান্য স্থানে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে।
ফেরত পাঠানো হচ্ছে না কাউকে
সোমবার সংবাদ সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন স্থান থেকে সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে জড়ো করে জোর করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে।
তবে এই প্রতিবেদনের সাথে দ্বিমত করে কোস্ট গার্ডের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে মঙ্গলবার বেনারকে বলেন তার বাহিনী ২,১৭৪ জন রোহিঙ্গাকে সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে জড়ো করে এবং পরে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে। তাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, সেন্ট মার্টিনসের স্থানীয় কিছু মানুষ ওই সকল রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল।
আমার তাদের আসতে বাধা দিচ্ছি, তবে আমরা তাদের জোর করে ফেরত পাঠাচ্ছি না, তিনি বলেন।
ইউরোপীয় কমিশনের মানবিক সহায়তা ও সংকট ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কমিশনার ক্রিসটোস স্টাইলিয়ানিডেস মঙ্গলবারের বিবৃতিতে বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সাড়ে তিন লাখ বিপদগ্রস্ত মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা দিতে ত্রাণ ও উদ্ধারকর্মীদের অবাধ প্রবেশ প্রয়োজন।
"সেখানকার বর্তমান মারাত্মক অবস্থার আরও অবনতি রক্ষা করতে তাদের (ত্রাণ কর্মীদের) অবশ্যই প্রবেশাধিকার দিতে হবে," তিনি বলেন।
"অনেক নিরীহ রোহিঙ্গা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে এবং সহিংসতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে যাচ্ছে। তাদের অবশ্যই ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না বা জোর করে ফেরত পাঠানো যাবে না," ক্রিসটোস স্টাইলিয়ানিডেস বলেন।
গত কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গাদের অবস্থান করতে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, রাখাইন রাজ্যে তাদের নিজস্ব আবাসভূমিতে ফিরে যাওয়ার মতো স্থিতিশীল পরিস্থিতি না হওয়া পর্যন্ত নতুনভাবে প্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সহায়তা ও নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নৌকা ডুবিতে মৃতের সংখ্যা ৫৮
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাইনুদ্দিন খান বেনারকে বলেন, পুলিশ মঙ্গলবার সীমান্ত নদী নাফ থেকে তিরিশোর্ধ এক নারীর লাশ উদ্ধার করেছে। তাঁর পরিচয় পাওয়া যায়নি।
এদিকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার পথে নৌকা ডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত অন্তত ৫৮ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন।