অব্যাহত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ: বাড়ছে উদ্ধার হওয়া লাশের সংখ্যাও
2017.09.06
ঢাকা ও কক্সবাজার

অব্যাহত অনুপ্রবেশের সাথে সাথে বাড়ছে বাংলাদেশে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের লাশের সংখ্যাও। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সহিংসতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আসার পথে বুধবার নৌকা ডুবি, অসুস্থতা এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় শিশুসহ তেরো রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বুধবার পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
এদিকে সীমান্ত এলাকায় মাইন বসানোর ঘটনায় মিয়ানমার দূতাবাসের চার্জ-দ্য-অ্যাফেয়ার্সকে তলব করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।
১৩ টি লাশ উদ্ধার
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাইনুদ্দিন খান বেনারকে বলেন, বুধবার ভোর তিনটার দিকে নাফ নদীতে রোহিঙ্গা শরণার্থী বোঝাই একটি নৌকা ডুবে গেলে পাঁচজন শিশু ও এক নারীর মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে আসার পথে অসুস্থ হয়ে আরও দুজন নারীর মৃত্যু হয় বলে তিনি জানান।
"আমরা শাহ পরীর দ্বীপ এলাকা থেকে ভেসে ওঠা পাঁচ শিশুর লাশ উদ্ধার করি। শিশুদের বয়স আনুমানিক সাত থেকে আট বছর হবে," খান বলেন।
মাইনুদ্দিন খান বলেন, টেকনাফ উপজেলার মৌলভীবাজার এলাকায় আরেক রোহিঙ্গা নারীর লাশ ভেসে উঠলে পুলিশ তা উদ্ধার করে।
তিনি আরও জানান, দুই রোহিঙ্গা নারী বাংলাদেশে আসার পথে শাহ পরীর দ্বীপ এলাকায় অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন।
এদিকে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের বলেন, বুধবার (৬ সেপ্টেম্বর) বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের আন্জুমানপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট থেকে উখিয়া সীমান্তে নারীসহ পাঁচ রোহিঙ্গার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
নো-ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সীমান্তের খুব কাছে সে দেশের সেনাবাহিনী এই এক নারী ও চার পুরুষকে গুলি করে হত্যা করে।
বুধবারের তেরোজনসহ আগস্ট ২৫ তারিখ থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৭১ জন রোহিঙ্গা নর-নারী-শিশুর মৃত্যু হলো। এদের অধিকাংশই সীমান্ত নদী নাফে নৌকা ডুবিতে মারা যায়।
টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের কাউন্সিলর নুরুল আমিন বুধবার বেনারকে বলেন, বুধবার ভোরে একাধিক নৌকা নাফ নদীতে ডুবে যায়।
"আমি নিজে কয়েকজন বেঁচে যাওয়া মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাকে জানিয়েছে নৌকাগুলোতে অনেক রোহিঙ্গা ছিল। আমাদের আশঙ্কা লাশের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে," আমিন বলেন।
বাংলাদেশে প্রবেশকারীদের সংখ্যা দেড়লাখ
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ঢাকা অফিসের কমিউনিকেশন অফিসার জোসেফ ত্রিপুরা বেনারকে বলেন, আমাদের কাছে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বুধবার দুপুর পর্যন্ত আনুমানিক এক লাখ ৪৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
"তবে এই সংখ্যা বাড়ছে," তিনি বলেন।
আমাদের কক্সবাজার প্রতিনিধি সীমান্তবর্তী টেকনাফ ও উখিয়া এলাকা থেকে জানান, নীলা, হোয়াইকং, খানজরপাড়া, উলুবুনিয়া, শাহপরীরদ্বীপ, টেকনাফ সমুদ্র সৈকত, লম্বা বিলসহ প্রায় ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আগমন অব্যাহত রয়েছে।
তবে সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিজিবির টেকনাফ অঞ্চলের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম বুধবার বেনারকে জানান, "তাদের অনুপ্রবেশ চলছেই। তবে আমরা বুধবার ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত ২,৬৪৯ জনকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা থেকে নিবৃত্ত করতে পেরেছি"।
তিনি বলেন, যারা বাংলাদেশে চলে আসছে, আমরা তাদের পটুবুনিয়া এলাকায় থাকতে বলছি।
"তবে আমরা কাউকে জোর করে ফেরত পাঠাচ্ছি না। আমরা সবাই তাদের সঙ্গে মানবিক ব্যবহার করছি," বলেন লে. কর্নেল আরিফুল ইসলাম।
টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আহমদ বেনারকে বলেন, সীমান্তে এখন কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। রোহিঙ্গারা দলে দলে প্রবেশ করছে, আর করছে।
বুধবার টেকনাফ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা মো. শাহ আলম (৪৫) বেনারকে বলেন, মিয়ানমার মিলিটারি ও মগেরা (বর্মিজ উগ্র বুদ্ধরা) গ্রামের পর গ্রাম আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। তাই রোহিঙ্গা পুরুষেরা প্রথমেই নারী-শিশুদের বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
আলম বলেন, মিলিটারিরা রোহিঙ্গা পুরুষদের দেখামাত্র হত্যা করছে। তাই পুরুষেরা বাঁচতে জঙ্গল-পাহাড়ে অনাহারে লুকিয়ে আছে। আর যারা পারছে, বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন মানবিক সহয়তা দিতে দাতাদের কাছে ১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে। আইওএম এই সাহায্য নবাগত রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় করবে।
সীমান্তে ল্যান্ড মাইন বসানোর অভিযোগ
মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে ল্যান্ড মাইন বসানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের তামব্রু ও ঘুমদুম এলাকায় অ্যান্টি পার্সোসেল ল্যান্ড মাইন বসানো হয়েছে বলে সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিজিবি কর্মকর্তারা বেনারকে জানিয়েছেন।
আর এই ল্যান্ড মাইনের বিস্ফোরণে দুই রোহিঙ্গার পা উড়ে গেছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন কক্সবাজার বিজিবির কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মনজুরুল হাসান খান।
"আমরা তামব্রু ও ঘুমদুম এলাকায় অ্যান্টি পার্সোসেল ল্যান্ড মাইনের বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছি। গত তিন দিন আগে একজন রোহিঙ্গা আমাদের কাছে এসেছিল। তার এক পা বিস্ফোরণে উড়ে গেছে," বলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল খান।
"গতকাল আরো দুটি শিশু আহত হয়ে আমাদের কাছে এসেছিল। তাদের একজনের পা উড়ে গেছে এবং অন্যজন মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। আমরা তাদের চিকিৎসা দিচ্ছি," তিনি বলেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বুধবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বাংলাদেশে মিয়ানমার দূতাবাসের চার্জ-দ্য-অ্যাফেয়ার্স অং মিন্টকে তলব করে সীমান্ত এলাকায় অ্যান্টি পার্সোনেল মাইন বসানোর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
ওই প্রতিবাদপত্রে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতা বন্ধে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছে যাতে রোহিঙ্গাদের অব্যাহত অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়। প্রতিবাদপত্রে বাংলাদেশ দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে যে রাখাইনে সাম্প্রতিক সামরিক অভিযানে নিরস্ত্র ও নিরপরাধ মানুষদের রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের চলমান অনুপ্রবেশ বাংলাদেশের জন্য ‘অসহ্য' পর্যায়ে পৌঁছেছে। রাখাইন রাজ্যে অতীতের কয়েক দফা সংঘর্ষের ফলে প্রায় চার লাখ মিয়ানমার নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
অবিলম্বে মিয়ানমারকে বাংলাদেশে অবস্থানরত তার সকল নাগরিককে ফিরিয়ে নিতে আহ্বান জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।