রোহিঙ্গা নারী-শিশু পাচার থেমে নেই, পুলিশ বলছে ‘কমেছে’

শরীফ খিয়াম ও আবদুর রহমান
2018.09.06
কক্সবাজার
180906-BD-rohingya-trafficking_1000.jpg উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের নির্গমন পথে কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী। ৩১ আগস্ট ২০১৮।
শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক জমিলা খাতুন (৩৬) ও তার স্বামী নূর হোসেন (৫০) ২০১২ সালে তাদের ছয় মেয়ে সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। প্রথমে তাঁরা যখন বান্দরবান থাকতেন, তখন সেখানকার পৌরসভার এক কর্মকর্তা তাঁদের দুই মেয়েকে নিজের বাসার গৃহকর্মী হিসাবে কাজ দেন।

পরে ওই কর্মকর্তাই তাঁদের আরও ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে ঢাকায় নিয়ে যান। সেখানে নেওয়ার পর মেয়ে দুটিকে বলা হয়, তারা যদি এখানে থাকতে রাজি না হয়, তবে তাদের বাবা-মাসহ পুরো পরিবারকে অত্যাচার করা হবে। ওই সময় তাদের বয়স ছিল ১৩ ও ৯ বছর।

এদিকে জমিলাকে বলা হয়, এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে তাঁর মেয়েরা বাঁচবে না। এরপর পাঁচ বছর ওই দুই মেয়ের সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না মা-বাবার। এরই মধ্যে ২০১৪ সালে পরিবারটি বান্দরবান থেকে কক্সবাজারের টেকনাফে লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলে আসে।

চলতি বছরের শুরুতে তাঁর বড় মেয়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে বান্দরবানে আসে। সেখানে সে জানতে পারে তার পরিবার এখন টেকনাফে রয়েছে। পরবর্তীতে তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ঢাকা থেকে অন্য মেয়েকে উদ্ধার করেন জমিলা।

লেদা ক্যাম্প ডেভেলপমেন্ট কমিটির অনুরোধে এ কাজে সহায়তা করে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। খোদ জামিলা খাতুন ও নূর হোসেন গত ২৬ আগস্ট বেনারের প্রতিনিধিদের এ ঘটনা জানান।

আন্তর্জাতিক একটি সাহায্য সংস্থার কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “গৃহ ও যৌনকর্মী হিসেবে পাচার হচ্ছে রোহিঙ্গা নারী-শিশুরা।” ভিকটিমদের সুরক্ষার স্বার্থে কোনো সংস্থাই এ বিষয়ক তথ্য প্রকাশ করবে না বলেও জানান তিনি।

তাঁর বক্তব্যের সত্যতা মেলে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) কর্মকর্তা কক্সবাজার কার্যালয়ের প্রধান সংযুক্ত সাহানির বক্তব্যে। এ সম্পর্কে কোনো তথ্য না দিয়ে তিনি বলেন, “এই বিষয়টি খুবই সেনসেটিভ।”

তবে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া থেকে রোহিঙ্গা নারী ও শিশু পাচার থেমে নেই। টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতাদের হাতে ২৬ আগস্টও দুই কিশোরী নিখোঁজের অভিযোগ এসেছে। আর উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প থেকে সর্বশেষ নিখোঁজ হয়েছে এক অষ্টাদশী তরুণী।

জেলার পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন বেনারকে বলেন, “নারী, শিশু পাচারের হার আগের চেয়ে কমে গেছে। তবে এখনো মাঝে মাঝে দুই-একজন ধরা পড়ছে।”

অন্যদিকে টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল মোতালব (৬৮) ও কুতুপালং ক্যাম্পের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফয়েজু আরকানি (৪৮) জানান, গত দুই মাসে এই দুই ক্যাম্পের কমপক্ষে ১০ নারী-শিশু নিখোঁজ হওয়ার খবর তাঁরা পেয়েছেন।

যদিও মোতালব বলেন, “এ জাতীয় অনেক ঘটনার খবর আমাদের কানে আসেই না। পরিবারের সদস্যরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে নানাভাবে তাদের খোঁজার চেষ্টা করে।” আর “ক্যাম্প থেকে পরিবারহীন কেউ হঠাৎ হারিয়ে গেলে সেটাও তাৎক্ষণিকভাবে বোঝার কোনো উপায় নেই,” বলেন ফয়জু।

এছাড়া তুলাবাগান ক্যাম্পের মাঝি দ্বীন মোহম্মদ (৩৫) জানান, সেখান থেকেও গত দুই মাসে কমপক্ষে পাঁচজন নিখোঁজ হয়েছে। যাদের প্রত্যেকের বয়স ১৮ বছরের কম।

গত বছরের আগস্টে রোহিঙ্গা ঢল নামার পর শিশু ও নারীদের পাচার এবং বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া রুখতে কক্সবাজারের ১৩টি পয়েন্টে তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ সদস্যরা কাজ করছেন ১১টিতে এবং সেনাবাহিনী ও বিজিবি দায়িত্ব পালন করছেন দুটিতে।

রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) দেওয়া তথ্য মতে, ক্যাম্প থেকে গত এক বছরে প্রায় ৫৮ হাজার রোহিঙ্গা পালাতে চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে ৫৪ হাজার ৫৫৯ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আটক হয়েছে। আরও তিন হাজার ২২১ জন রোহিঙ্গাকে আটক হয়েছে দেশের অন্যান্য জেলায়। পরবর্তীতে তাঁদের সবাইকে শরণার্থী শিবিরে ফিরিয়ে আনা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

২০০২ সালে বাংলাদেশে প্রবেশ করা লেদার রোহিঙ্গা চেয়ারম্যান মোতালেব বেনারকে বলেন, “২০১২ সাল থেকে মানবপাচারের প্রকোপ বেড়ে গেছে। ইদানীং এর পরিমাণ কিছুটা কমলেও প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটছে।”

রবিবার হাতে পাওয়া একটি লিখিত অভিযোগ বেনারকে দেখিয়ে তিনি জানান, ১১ ও ১২ বছরের দুই কন্যাকে গত ১৫ আগস্ট থেকে খুঁজে পাচ্ছেন না তাদের মা সখিনা খাতুন। তিনিই এই অভিযোগ করেছেন।

টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের ভেপলমেন্ট কমিটির কাছে গত ২৬ আগস্ট দাখিল করা এই অভিযোগপত্রে দুই রোহিঙ্গা কিশোরীকে ‘চাকরির প্রলোভন’ দেখিয়ে পাচারের কথা জানিয়েছেন তাদের মা সখিনা খাতুন। ২৬ আগস্ট ২০১৮।
টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের ভেপলমেন্ট কমিটির কাছে গত ২৬ আগস্ট দাখিল করা এই অভিযোগপত্রে দুই রোহিঙ্গা কিশোরীকে ‘চাকরির প্রলোভন’ দেখিয়ে পাচারের কথা জানিয়েছেন তাদের মা সখিনা খাতুন। ২৬ আগস্ট ২০১৮।
শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ

 

পাচারে জড়িত রোহিঙ্গা নারীও

অভিযোগে লেখা রয়েছে, তাদের ‘চাকরির প্রলোভনে’ দেখিয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত রশিদা ও কেইশগনী নামের দুই রোহিঙ্গা নারী। তিন হাজার টাকা খরচ করে চট্টগ্রাম গিয়ে তাদের খোঁজ করেও সন্ধান পাননি সখিনা।

এসপি ইকবালও বেনারকে বলেন, “এ জাতীয় পাচারের সাথে স্থানীয়দের সংশ্লেষ অনেক কম। যারা ধরা পরছে, তাদের প্রায় সবাই রোহিঙ্গা।” তবে মোতালেবের দাবি, স্থানীয়দের যোগসাজশেই এ কাজে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা।

অন্যদিকে কুতুপালংয়ের ফয়জু জানান, তাঁর ক্যাম্পে সর্বশেষ যে তরুণীটি নিখোঁজ হয়েছে, তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে কক্সবাজার নিয়ে আসা হয়েছিল।

কক্সবাজারের একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা শহরের একাধিক আবাসিক হোটেলের নাম উল্লেখ করে বেনারকে জানান, এগুলোর প্রত্যেকটিতে রোহিঙ্গা যৌনকর্মী রয়েছে।

এ ছাড়া কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের প্রত্যেক অবস্থাসম্পন্ন পরিবারে এখন এক বা একাধিক রোহিঙ্গা গৃহকর্মী আছে বলে বেনারকে জানান উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী।

যদিও এমন অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন এসপি।

এদিকে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রস (আইসিআরসি), ন্যাশনাল রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির রিস্টোরিং ফ্যামিলি লিংক (আরএফএল) কর্মসূচির পরিচালক ইমাম জাফর শিকদার বেনারকে বলেন, “নারী-শিশু নিখোঁজের কিছু ঘটনা ঘটেছে, তবে এর সংখ্যা বেশি নয়।”

তবে এই কর্মসূচির মাঠকর্মী আতিকুর রহমান রাব্বী বেনারকে জানান, গত ১৫ দিনে ১১৪ জন এবং তার আগের ১৫ দিনে আরও ১৪২ জন রোহিঙ্গা নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়েছেন তারা।

যদিও তার দাবি, “এরা ক্যাম্প থেকে নয়, মিয়ানমার থেকে আসার সময়ই হারিয়ে গেছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।