রোহিঙ্গা সংকট: বাংলাদেশের পাশে থাকবে তুরস্ক
2017.09.07
ঢাকা ও কক্সবাজার

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিয়ে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে তুরস্ক। বৃহস্পতিবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন শেষে সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে এই আশ্বাস দেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোয়ান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেগলুত কাবাসোগলু।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বেনারকে জানান, “পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে এ সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জানান।”
এদিকে বৃহস্পতিবার ১৮ হাজার নতুন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে এবং বাংলাদেশে আসার পথে নৌকা ডুবিতে শিশুসহ ১৫ রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে জাতিসংঘ ও স্থানীয় প্রশাসন সূত্র।
শরণার্থী শিবিরে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি
বৃহস্পতিবার দুপুরে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে যান তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এবং দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। শুরুতেই তাঁরা রোহিঙ্গাদের কাছে নির্যাতনের বর্ণনা শোনেন। এরপর তুরস্কের পক্ষ থেকে কয়েকজনের হাতে ত্রাণ তুলে দেন এমিন এরদোয়ান।
এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম।
এমিন এরদোয়ান সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ যা করছে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এই মানবিক বিপর্যয় থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে তুরস্ক সব সময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে।
এ সময় তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভাসোগলু বলেন, “রোহিঙ্গারা নিজ দেশে আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। তাদের সহায়তা দেওয়া আমাদের প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে।”
তুরস্কের ফার্স্ট লেডি সাংবাদিকদের বলেন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘের আগামী সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের বিষয় তুলে ধরবেন।
রোহিঙ্গা শিবির থেকে ফিরে সন্ধ্যায় তিনি ও তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের এ দেশে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে শুধু মানবিক কারণে। এটা বাংলাদেশের জন্য বড় বোঝা হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে হবে।
তুরস্কের ফার্স্ট লেডি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তুরস্ক রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত তুলে ধরবে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব সারা বিশ্বের।
গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা ও পুলিশ চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর সেনা অভিযান শুরু হলে পুনরায় রোহিঙ্গা স্রোত শুরু হয় বাংলাদেশ সীমান্তমুখে।
নৌকা ডুবিতে ১৫ প্রাণহানি
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা থেকে রেহাই পেতে নৌকায় চেপে বাংলাদেশে প্রবেশে করতে গিয়ে বৃহস্পতিবার আরও ১৫ জন রোহিঙ্গা শিশু ও নারী প্রাণ হারিয়েছেন, বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ ও স্থানীয়রা।
বৃহস্পতিবার সকালে রোহিঙ্গা বোঝাই একটি নৌকা সীমান্ত নদী নাফে ডুবে গেলে তারা প্রাণ হারায়। গতকাল বুধবার একই নদীতে আরেক নৌকা ডুবির ঘটনায় আট রোহিঙ্গা মারা যান।
নিহতদের সকলকে দাফন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ ও উখিয়া পুলিশ।
রাখাইন রাজ্যে আগস্ট মাসের ২৫ তারিখ থেকে সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর পালিয়ে বাংলাদেশের আসার পথে এ পর্যন্ত প্রাণ হারায় কমপক্ষে ৮৬ জন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
“আমরা আজ নাফ নদী থেকে এগারোটি লাশ উদ্ধার করেছি,” টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাইনুদ্দীন খান বেনারকে বলেন।
তিনি বলেন, তিন শিশু ও এক নারীর লাশ শাহপরীর দ্বীপ থেকে, দুজন নারী ও দুই শিশুর মরদেহ টেকনাফ থেকে এবং দুই শিশু ও এক নারীর লাশ বাহারছড়া এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়।
এছাড়া বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় টেকনাফের তুলাতুলি এলাকার পুলিশ আরও তিন শিশু ও এক নারীর লাশ উদ্ধার করেছে বলেও জানান তিনি।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল খায়ের বেনারকে বলেন, বুধবার আন্জুমানপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট থেকে উদ্ধার করা নারীসহ পাঁচ রোহিঙ্গার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ বৃহস্পতিবার দাফন করা হয়েছে।
অনুপ্রবেশ ১ লাখ ৬৪ হাজার
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ঢাকা অফিসের কমিউনিকেশন অফিসার জোসেফ ত্রিপুরা বেনারকে জানান, বৃহস্পতিবার আরও ১৮ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
তাঁর তথ্যানুসারে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত আনুমানিক এক লাখ ৬৪ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
তবে সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিজিবির টেকনাফ অঞ্চলের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান, তার বাহিনী বৃহস্পতিবার সকালে ২,০৫২ জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা থেকে নিবৃত্ত করেছে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ ও বাংলাদেশে তাদের আশ্রয় দেয়ার দাবিতে বিএনপি শুক্রবার সারা দেশে মানব বন্ধন করবে বলে জানিয়েছেন দলটির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
সরকার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার অভিযোগ করেন তিনি।
এদিকে রোহিঙ্গাদের আগমনকে জনস্রোত হিসেবে উল্লেখ করে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন," জনস্রোতের এই বিশাল বোঝা বহনের ক্ষমতা আমাদের নেই।"
জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্বেগ
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যানটোনিও গুটারেস নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্টের কাছে লেখা এক চিঠিতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
"আমি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছি। কিন্তু এখন আমরা প্রতিনিয়ত মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর নির্বিচার আক্রমণ ও সহিংসতার খবর পাচ্ছি," বলেন গুটারেস। এর ফলে রেডিকালাইজেশন বাড়বেই, তিনি বলেন।
“শরণার্থীদের তাদের দেশে প্রবেশ করতে দেওয়ায় আমি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রেটফুল, এবং নবাগতদের প্রয়োজন মেটাতে ব্যবস্থা নিতে উৎসাহ প্রদান করছি," বলেন গুটারেস।
মিয়ানমার সারকারকে এই সহিংসতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে এবং সকলকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিতে হবে, গুটারেস বলেন।
তিনি কফি আনান কমিশনের রিপোর্টের পুরোপুরি বাস্তবায়ন দাবি করেন।
এদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বুধবার বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফ্রেডিরিকা মোঘারিনি।