রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চার ভাগের একভাগ উদ্বাস্তু হয়েছেন গত দুই সপ্তায়

কামরান রেজা চৌধুরী ও আবদুর রহমান
2017.09.08
ঢাকা ও কক্সবাজার
টেকনাফের কানজর পাড়া পয়েন্টে ধানের খেত দিয়ে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। টেকনাফের কানজর পাড়া পয়েন্টে ধানের খেত দিয়ে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের একভাগ থেকেও বেশি মানুষ গত দুই সপ্তায় রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতা থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে। এর প্রেক্ষিতে শুক্রবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে বলেছে, একটি পুরো জাতিকে নির্মূল করতে যেসব কর্মকাণ্ড চালানো হয়ে থাকে, তার সবই ঘটছে মিয়ানমারে।

এদিকে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজসহ দেশের বিভিন্ন সংগঠন। পাশাপাশি, রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয় দেবার আশ্বাস দিয়েছে মালয়েশিয়া।

গত দুই সপ্তায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আনুমানিক ২ লাখ ৭০ হাজার বলে শুক্রবার জানিয়েছেন জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর মুখপাত্র দুনিয়া আসলাম খান।

গত মাসে প্রকাশিত জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের প্রতিবেদনে মিয়ানমারে মোট রোহিঙ্গা জনসংখ্যা দশ লাখের মতো বলে উল্লেখ করা হয়। সে হিসাবে রোহিঙ্গাদের চার ভাগের একভাগ থেকেও বেশি মানুষ গত দুই সপ্তায় উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন।

এদিকে পুলিশের তথ্য অনুসারে ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে আসার পথে নৌকা ডুবি ও অন্যান্য ঘটনায় কমপক্ষে ৮৮ জন রোহিঙ্গা মারা গেছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।

রাখাইন রাজ্যের দারগার ডেইলপাড়ার অধিবাসী আবু বক্কর বেনারকে বলেন, “পয়লা সেপ্টেম্বর সেনারা আমার চার ছেলে আবু সৈয়দ, আবদুল খালেক, আবুল বশর ও আবদুর রাজ্জাককে ঘরে আটকে রেখে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়। এরপর ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারা আগুনে পুড়ে মারা যায়।”

তিনি বলেন, বাড়ির বাইরে থাকায় তিনি ও তার পরিবারের অন্য তিন সদস্য বেঁচে যান।

সপ্তাহখানেক লুকিয়ে থাকার পর শুক্রবার সকালে টেকনাফের হ্নীলা দিয়ে তিনি ও পরিবারের অন্য তিনজন বাংলাদেশে প্রবেশ করেন বলে জানান তিনি।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধের দাবিতে বাংলাদেশ সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজ মানববন্ধন করে। ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধের দাবিতে বাংলাদেশ সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজ মানববন্ধন করে। ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চলছে: এইচআরডব্লিউ

শুক্রবার প্রকাশিত হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) বিবৃতিতে বলা হয়, “জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি সভা ডাকা উচিত। ওই সভায় মিয়ানমারকে বলা হবে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে নৃশংস নিপীড়ন বন্ধ না হলে দেশটি চরম নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়বে।”

সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ পঞ্চাশেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাক্ষাৎকার নেয়। সীমান্ত পেরিয়ে তাঁরা বাংলাদেশে ঢুকেছেন। তাঁদের মধ্য থেকে ডজনখানেকেরও বেশি মানুষ অত্যাচারের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।

তাঁরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, মিয়ানমার সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। তাদের বুলেট ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে আহত করে, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। সেনাসদস্যরা ছোট অস্ত্র, মর্টার ও অস্ত্রবাহী হেলিকপ্টার থেকে হামলা চালায় বলেও উল্লেখ করেন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ভূ উপগ্রহ থেকে তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করেছে। গতকাল পর্যন্ত হিউম্যান রাইটস ওয়াচ রাখাইন রাজ্যের এমন ২১ টি জায়গা খুঁজে পেয়েছে, যেখানে বড় পরিসরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

তবে বর্মি সরকার এসব অত্যাচারের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাঁরা বলছে, জঙ্গিবিরোধী তৎপরতা দমনে তারা কাজ করছে এবং এতে এখন পর্যন্ত ৪শ জন মারা গেছে। নিহতদের বড় অংশই সন্দেহভাজন জঙ্গি। যদিও জাতিসংঘের হিসাব মতে এখন পর্যন্ত সেখানে ১ হাজারেরেও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

“বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রাথমিক তদন্ত প্রমাণ করে রাখাইন রাজ্যে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চলছে,” বলেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশীয় পরিচালক মীনাক্ষী গাংগুলী।

মার্কিন সিনেটের নিন্দা প্রস্তাব

রাখাইনের ঘটনার নিন্দা জানিয়ে গতকাল মার্কিন সিনেটে যৌথভাবে প্রস্তাব পেশ করেন ডেমোক্রেট সিনেটর ডিক ডারবিন ও রিপাবলিকান সিনেটর জন ম্যাককেইন। ওই প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার নিন্দা জানানো হয়েছে। ওই প্রস্তাবে মানবিক বিপর্যয় বন্ধে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচিকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের আদর্শের প্রতি তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা সমুন্নত রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে। মার্কিন সিনেটরদের প্রস্তাবে জঙ্গি গোষ্ঠি আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মির হামলার নিন্দা জানানো হয়েছে।

এদিকে রাখাইনে সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন মন্ত্রী মারি ক্লদ বিবু গতকাল এক বিবৃতিতে গভীর নিন্দা জানিয়েছেন।

আশ্রয় দেবে মালয়েশিয়া

শুক্রবার বার্তাসংস্থা রয়টার্স মালয়েশিয়ার মেরিটাইম এজেন্সির মহাপরিচালক জুলফিকলি আবু বাকার এর বরাত দিয়ে জানায়, শরণার্থী রোহিঙ্গাদের বিশেষ অভিবাসন কেন্দ্রে থাকতে দেবার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি।

“সাধারণত আমরা তাঁদেরকে (অনুপ্রবেশকারীদের) কিছু প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে আবার ফেরত পাঠিয়ে দেই। কিন্তু মানবিক কারণে এবার বোধহয় তা করা যাবে না,” রয়টার্সকে বলেন আবু বাকার।

বর্তমানে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে মালয়েশিয়ায়। এখন পর্যন্ত সেখানে নতুন কোনো রোহিঙ্গার আগমন না ঘটলেও, পরিস্থিতি বিবেচনায় মালয়েশিয়ায় নতুন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আগমন ঘটতে পারে বলেও মন্তব্য করেন আবু বাকার।

এদিকে শুক্রবার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক এর দপ্তর থেকে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে ও মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সহায়তা ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার।

“বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের দুইপাশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জরুরি প্রয়োজন ও আশ্রায়ণে সহায়তার জন্য এটি একটি সমন্বিত ত্রাণ মিশন,” বলা হয় বিবৃতিতে।

বৌদ্ধ সমাজের প্রতিবাদ

মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজ। শুক্রবার সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশের সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজ মানববন্ধনের আয়োজন করে।

মানববন্ধনে সংগঠনের মুখ্য সমন্বয়ক অশোক বড়ুয়া লিখিত বক্তব্যে মিয়ানমারের ঘটনাকে মানবিক বিপর্যয় হিসেবে উল্লেখ করে রোহিঙ্গাদের রক্ষায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাহায্য কামনা করেন।

“মিয়ানমার একটি বৌদ্ধপ্রধান দেশ হিসেবে বৌদ্ধধর্মবিরোধী কাজ করছে। বৌদ্ধধর্মে এভাবে মানুষ নির্যাতনের কোনো অনুমোদন নেই। অবিলম্বে এই নিপীড়ন বন্ধ হোক,” বলেন বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি অসীম রঞ্জন বড়ুয়া।

সংগঠনটির পক্ষ থেকে রোববার ঢাকার মিয়ানমার দূতাবাসে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়।

মিয়ানমার দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচি

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়নের প্রতিবাদে আগামী সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) গণজাগরণ মঞ্চ মিয়ানমার দূতাবাস ঘেরাও করবে বলে জানিয়েছেন মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।

এছাড়া শুক্রবার ঢাকার বায়তুল মোকাররমে এক বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার দূতাবাস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দিয়েছেন ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ এর নায়েবে আমির মুফতি ফয়জুল করিম।

এদিকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও গণহত্যার প্রতিবাদে শুক্রবার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিসহ দেশের বিভিন্ন মসজিদে জুমার নামাজের মোনাজাতে দোয়া করা হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।