ভাসানচরে আবাসন ব্যবস্থা দেখে মুগ্ধ রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা

আবদুর রহমান ও শরীফ খিয়াম
2020.09.08
কক্সবাজার ও ঢাকা
200908-BD-rohingya-1000.jpg ভাসানচরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের সবজির বাগান ঘুরে দেখছেন সরফরকারী রোহিঙ্গা নেতারা। ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০।
[সৌজন্যে: রোহিঙ্গা প্রতিনিধি মোস্তফা কামাল]

রোহিঙ্গাদের এক অংশকে স্থানান্তরের জন্য নোয়াখালীর ভাসানচরে গড়ে তোলা আবাসন ব্যবস্থা দেখে শরণার্থী নেতারা বলেছেন, ওই দ্বীপ সম্পর্কে তাঁদের ভীতি কেটে গেছে।

ভাসানচর বাসযোগ্য কি না তা দেখাতে শনিবার কক্সবাজার থেকে নোয়াখালীর হাতিয়ার ওই দ্বীপে রোহিঙ্গা নেতাদের নেওয়া হয়। প্রতিনিধি দলটি মঙ্গলবার ফিরে ওই দ্বীপটি সম্পর্কে তাঁদের সন্তোষ প্রকাশ করেন।

“সব দেখে আমাদের মনে হয়েছে, কিছু রোহিঙ্গা এখানে আসতে রাজি হতে পারে। বিশেষ করে যারা মিয়ানমারে উপকূলীয় বা নদী তীরবর্তী এলাকায় থাকতেন, তাঁদের এই জায়গা পছন্দ হবে,” ভাসানচর থেকে ফিরে মঙ্গলবার বেনারকে বলেন শালবন শরণার্থী শিবিরের নেতা হেফজুর রহমান।

এদিকে পরিদর্শনে যাবার ফলে ভাসানচর সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের ‘অমূলক ভীতি’ কেটে গেছে বলে বেনারকে জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মাহবুব আলম তালুকদার।

“মূলত এ জন্যই সরকারের সিদ্ধান্তে সেখানকার অবস্থা নিজ চোখে দেখতে তাঁদের পাঠানো হয়েছিল,” বলেন তিনি।

জাতিসংঘসহ শরণার্থীদের মানবিক সেবাদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিরোধিতা সত্ত্বেও কমপক্ষে এক লাখ শরণার্থীকে ওই দ্বীপে স্থানান্তর করার লক্ষ্যে চলমান সরকারি প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা দ্বীপটিতে সফর করে এসেছেন দুই নারীসহ ৪০ জন রোহিঙ্গা নেতা।

শনিবার বিকেলে ভাসানচরে পৌঁছানোর পর রোহিঙ্গা নেতাদের সেখানকার আবাসন প্রকল্পের ওপর একটি ভিডিও দেখানো হয়। রবি ও সোমবার এলাকাটি ঘুরে দেখেন তাঁরা।

“এখানকার পরিবেশ সম্পর্কে যেসব ভীতিকর কথা শুনেছিলাম, তেমন কিছুই দেখলাম না। বরং এখানকার নিরাপত্তা ও সুরক্ষাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা খুবই সুন্দর। যা দেখেছি তার সবই ভালো লেগেছে,” বেনারকে বলেন জাদিমুড়া রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা মোহাম্মদ কালাম।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের স্থাপনাগুলো খুবই গোছালো ও নিরাপদ উল্লেখ করে লেদা নতুন শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা মোস্তফা কামাল বেনারকে জানান, সেখানকার পরিবেশ বেশ স্বস্তিকর।

ভাসানচরে তাঁরা খাদ্য গুদাম, থাকার জায়গা, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্কুল, খেলার মাঠ, কবরস্থান, মাছ চাষের পুকুর, বিভিন্ন প্রকারের সবজির বাগান এবং সাগর তীরে কেওড়ার বেষ্টনী দেখে মুগ্ধ হওয়ার কথা জানান মোস্তফা।

আসার আগে দ্বীপের বেড়িবাঁধসহ অন্যান্য স্থাপনাগুলোও তাঁদের ঘুরিয়ে দেখানো হয় বলে জানান তিনি।

“এসব স্থাপনার অবকাঠামো বেশ পরিকল্পিত ও মজবুত। সফরে আসা রোহিঙ্গা নেতাদের সবারই খুব পছন্দ হয়েছে। সব কিছু দেখে আমরা মুগ্ধ। মানুষের বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে এখানে,” বলেন রোহিঙ্গা নেতা হেফজুর রহমান।

শরণার্থী কমিশনার মাহবুবের ধারণা, সফরকারীদের মুখে ভাসানচরের বিবরণ শুনে অনেক রোহিঙ্গাই সেখানে যেতে রাজি হবেন।

তবে স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরুর সিদ্ধান্ত নেবার আগে “কে কে যেতে চায় তা জানতে চেয়ে প্রত্যেক ক্যাম্প থেকে তালিকা নেওয়া হবে” বলে জানান শরণার্থী কমিশনার।

ভাসানচরে রোহিঙ্গা নেতাদের পরিদর্শন সেখানে যাবার বিষয়ে শরণার্থীদের ‘সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে’ বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এর ঢাকা কার্যালয়ের মুখপাত্র মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন।

“যে কোনো স্থানান্তর হওয়া উচিত স্বেচ্ছায়,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, স্থানান্তরের আগে “শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সর্বোচ্চ বিবেচনায় আনা উচিত।”

“ভাসানচরে শরণার্থীদের স্থানান্তরের আগে সেখানকার নিরাপত্তা ও টেকসই অবস্থা নিশ্চিতের জন্য একটি সুষ্ঠু ‘টেকনিক্যাল এসেসমেন্ট’ (কারিগরি সমীক্ষা) প্রয়োজন,” যোগ করেন তিনি।

এদিকে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে রাজি করাতে পারলে সারা বিশ্বের জন্য একিট দৃষ্টান্ত তৈরি হবে বলে মনে করেন অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর।

তাঁর মতে, দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা রেখেও শরণার্থীদের স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ করে দেওয়া গেলে আন্তর্জাতিক মহলের সাথে কূটনৈতিকভাবে সমঝোতা করতেও সুবিধা হবে বাংলাদেশের।

তবে ভাসানচরে যাওয়া রোহিঙ্গারা ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ছাড়তে রাজি নাও হতে পারে বলে আশঙ্কা করেন এই বিশ্লেষক।

প্রাথমিকভাবে টেকনাফ-উখিয়ার ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরের তিন নারীসহ ৪৭ জন প্রতিনিধির ভাসানচরে যাবার কথা থাকলেও কক্সবাজার থেকে রওনা হওয়ার আগ মুহূর্তে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর সাত জনকে বাদ দেওয়া হয় বলে জানান রোহিঙ্গা নেতারা।

এর আগে তাঁদের সবার করোনাভাইরাসও পরীক্ষা করা হয়েছিল।

“কুতুপালংয়ে ট্রানজিট পয়েন্টে রাতেও ছিলাম। কিন্তু স্বাস্থ্যের অবস্থা খারাপ হওয়ায় যাওয়া হয়নি,” বেনারকে বলেন প্রতিনিধিদল থেকে বাদ পড়া টেকনাফের লেদা শরণার্থী শিবিরের ডেভেলপমেন্ট কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলম।

পরিদর্শনে যাওয়া শরণার্থী নেতাদের কাছে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন চার মাস ধরে ভাসানচরে থাকা রোহিঙ্গা নারী-শিশুরা। ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০।
পরিদর্শনে যাওয়া শরণার্থী নেতাদের কাছে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন চার মাস ধরে ভাসানচরে থাকা রোহিঙ্গা নারী-শিশুরা। ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০।
[সৌজন্যে: রোহিঙ্গা প্রতিনিধি মোহাম্মদ কালাম।]

স্বজনদের কাছে ফিরতে চান ভাসানচরের রোহিঙ্গারা

বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা তিন শতাধিক রোহিঙ্গাকে গত মে মাসে ভাসানচরে নিয়ে যায় সরকার।

সফরকারীরা জানিয়েছেন, সেখানে বসবাসকারী ৩০৬ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে স্বজনদের কাছে ফিরতে উদগ্রীব।

সফরের দ্বিতীয় দিন রবিবার দুপুরে সেখানকার রোহিঙ্গাদের সাথে প্রতিনিধিদলের দেখা হয় জানিয়ে শরণার্থী নেতা কালাম বেনারকে বলেন, “আমাদের কাছে পেয়ে তাঁরা অনেক কান্নাকাটি করেন। তাঁদের অনেকের আত্মীয়-স্বজন কক্সবাজারে আছে। শরণার্থী শিবিরে আত্মীয়দের কাছে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন তাঁরা।”

তবে সেখানে তাঁদের থাকা-খাওয়ার কোনো সমস্যা হচ্ছে না বলে জানান প্রতিনিধিরা।

“তারা সেখানে হয় স্বজনদের নিয়ে থাকতে চায়, না হয় কক্সবাজারের শিবিরে থাকা পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরতে চায়। কয়েকজন আমাদের সঙ্গেই ফিরে আসতে চেয়েছিল,” বলেন হেফজুর।

সেখানকার রোহিঙ্গাদের ভেতর ১৮৬ জন নারী, ৯৬ জন পুরুষ ও ২৪ জন শিশু রয়েছেন জানিয়ে রোহিঙ্গা নেতারা জানান, নারীদের অধিকাংশই অবিবাহিত।

প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ভাসানচরে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে প্রায় দুই ঘন্টা সময় কাটিয়েছেন জানিয়ে প্রতিনিধিদের সাথে থাকা হাতিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) গোলাম ফারুক বেনারকে বলেন, “তবে তাঁদের মধ্যে কী কথা হয়েছে তা আমার বুঝতে পারিনি।”

এদিকে সমুদ্র থেকে উদ্ধারের পর ওই রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় সাময়িক সঙ্গনিরোধের কথা বলে ভাসানচর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জানিয়ে বিশ্লেষক আসিফ মুনীর বলেন, “এখন তাঁদের যদি ফিরে আসতে দেওয়া না হয়, তবে সেটা খুবই খারাপ আচরণ হবে।”

তাঁদেরকে আত্মীয়-স্বজন থেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা ‘অমানবিক’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তবে ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের বিষয়ে “এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি,” বলে জানান আরআরআরসি মাহবুব।

“এই মুহূর্তে আমাদের ভাসানচর পরিদর্শনের জন্য সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। যাতে সেখানে অবস্থানরত শরণার্থীদের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে পারা যায়,” বলেন ইউএনএইচসিআর মুখপাত্র সাজ্জাদ।

প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার।

সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।

বর্তমানে ভাসানচরে থাকা ৩০৬ রোহিঙ্গার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।

রোহিঙ্গারা সেখানে ‘খুবই ভালো আছে’ বলে এর আগে বেনারকে জানিয়েছিলেন ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক ও নৌবাহিনীর কমোডর এ এ মামুন চৌধুরী।

সমুদ্রপথে ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গা

ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, সাত মাস সমুদ্রে ভেসে থাকার পর সোমবার সকালে ইন্দোনেশিয়ার উত্তরের উপকূলে আশ্রয় পেয়েছে প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গা। যার মধ্যে ১০২ জন পুরুষ, ১৮১ জন মহিলা এবং ১৪ শিশু বলে উল্লেখ করেছে বার্তা সংস্থা এএফপি।

সোমবার এক বিবৃতিতে ইউএনএইচসিআর জানায়, গত ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজার উপকূল থেকে আনুমানিক ৩৩০ জনের এই দলটি যাত্রা শুরু করেছিল। পথে কমপক্ষে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে ইন্দোনেশিয়ায় উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা দলটির সংবাদ জানলেও তাঁরা সবাই কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা ছিলেন কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে বেনারকে জানান কক্সবাজারে শরণার্থী ক্যাম্পের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হেমায়েতুল ইসলাম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।