রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অপরাধ স্বীকার করা দুই সেনাসদস্য আন্তর্জাতিক আদালতের জিম্মায়
2020.09.10
ঢাকা
তিন বছর আগে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণসহ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করার স্বীকারোক্তি দেয়া মিয়ানমারের দুই সেনা সদস্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের জিম্মায় রয়েছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন ফরটিফাই রাইটস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমারের ওই দুই সেনাসদস্যের স্বীকারোক্তি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গাম্বিয়ার করা মামলার অবস্থানকে শক্তিশালী করবে।
গাম্বিয়ার অভিযোগ হচ্ছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ নামক মিয়ানমারের সামরিক অভিযানে গণহত্যা সংঘঠিত হয়েছে।
এই অভিযোগ অস্বীকার করে মিয়ানমার বলছে, ওই দুই সেনা সদস্যকে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সেনাসদস্য মিও উইন তুন (৩৩) এবং জ নাইং তুন (৩০) এর স্বীকারোক্তি নিয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
তাঁরা দুজনই ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য হিসাবে মানবতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত ছিলেন।
ফরটিফাই রাইটস জানিয়েছে, সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা ওই দুই সৈনিক রাখাইন রাজ্যের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির হাতে আটক হন। বিভিন্ন দাবিতে দীর্ঘ দিন থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে আরাকান আর্মি।
আরাকান আর্মি ওই দুই সৈনিকের ভিডিও রেকর্ড করে। ওই ভিডিও ক্লিপ ফরটিফাই রাইটস এর কাছে আছে।
কী বলেছেন তাঁরা?
ফরটিফাই রাইটস জানায়, ৮ জুলাই আরাকান আর্মির করা ভিডিওতে দেখা যায়, মিও উইন তুন বলেন, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে বুথিডং ও আশেপাশের এলাকায় রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের তিনি হত্যা করেছেন, তংবাজার এলাকায় রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করেছেন।
২৩ জুলাই করা ভিডিওতে জ নাইং তুন বলেন, ২০১৭ সালে সামরিক অভিযানে তিনি মংডু এলাকার পাঁচ গ্রামে রোহিঙ্গা হত্যায় অংশ নেন, গণকবর দেন এবং অন্যান্য অপরাধ করেন।
ওই সামরিক অভিযানের ফলে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেন। নতুন ও পুরাতন মিলিয়ে বর্তমানে কমপক্ষে ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছেন।
দুই সেনা সদস্যের মতে, তাঁরা ওপরের নির্দেশে এই কাজগুলো করেছেন। তাঁরা ছাড়াও আরো অন্তত ১৭ জন সেনাসদস্যের রোহিঙ্গা নিধনের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
একজন কর্নেল, একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং তিন ক্যাপ্টেন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপরাধ করতে সেনাদের নির্দেশ দেন বলে জানান তাঁরা।
ওই সেনা সদস্যরা আরও জানান, রোহিঙ্গাদের সবাইকে ‘নিশ্চিহ্ন’ করতে ‘যাদের দেখবে বা আওয়াজ শুনবে’ প্রত্যেককে গুলি করতে আদেশ দেয়া হয়েছিল। ভিডিওর বক্তব্য অনুসারে, ওই দুই সেনা সদস্যকে অন্তত ১৮০ জন রোহিঙ্গা হত্যার জন্য দায়ী করা হতে পারে।
ভিডিওতে মিও বলেন, “১৫ সামরিক অপারেশন কমান্ডের কর্নেল থান তিকের নির্দেশে আমি ৩০ জন নিরীহ মুসলিম পুরুষ, নারী ও শিশুকে হত্যা করে বুথিডং এলাকার তং বাজারে গণকবর দিয়েছি।”
তিনি বলেন, কোচিন রাজ্যের মোহনিইন রেল স্টেশনে তিনি ঘুমাচ্ছিলেন। সেখান থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়।
মিও বলেন, “আমি শান গোত্রের হওয়ায় বার্মিজ সেনা কর্মকর্তারা আমাকে ভয় দেখাত এবং আমার প্রতি বৈষম্য করত। আমি সেনাবাহিনী ত্যাগ করতে চেয়েছি। কিন্তু তারা আমাকে সেই অনুমতি দেয়নি। সেজন্য আমি সেনাবাহিনী ছেড়ে পালিয়ে এসেছি।”
মিয়ানমার বরাবর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘঠিত অপরাধ অস্বীকার করে আসছে। তাঁদের ভাষায়, রোহিঙ্গাদের জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির আক্রমণের জবাবে সেনাবাহিনী ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালিয়েছে।
এই দুই সেনা সদস্য প্রথম মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অপরাধ সম্পর্কে স্বীকারোক্তি দিলেন।
ফরটিফাই রাইটস জানায়, আগস্টের মাঝামাঝি বাংলাদেশ সীমান্তে এসে বাংলাদেশ সরকারের সুরক্ষা দাবি করেন মিও উইন এবং জ নাইং।
নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ তাঁদের হেগ শহরের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাছে সমর্পণ করে।
তবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এই ঘটনার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও মন্ত্রণালয়ের রোহিঙ্গা শাখার মহাপরিচালক দেলোয়ার হোসেন এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
মিয়ানমার সেনা সদস্যদের এই স্বীকারোক্তি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণে সহায়তা করবে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির শিক্ষক ড. তারেক শামসুর রেহমান।
তিনি বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার সেনা সদস্যরা যে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছেন দুই সেনা সদস্যের বক্তব্যে তা প্রমাণ হলো।”
তিনি বলেন, “এই দুই সেনা সদস্য নিজেদের সিদ্ধান্তে এসব অপরাধ করেননি। উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে এটা করেছেন। তাই মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ সামরিক নেতৃত্বকে এই ঘটনার জন্য দায়ী করা যায়। একইসাথে সেখানকার রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এই ঘটনার দায় নিতে হবে।”
ড. তারেকের মতে, “বাংলাদেশ এই ঘটনার সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট হবে না। কারণ, মিয়ানমারের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা করেছে গাম্বিয়া। আর এই বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করছে মিয়ানমার। বাংলাদেশের ভূমিকা হলো, অসহায় রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিতে হয়েছে।”
তিনি বলেন, “মিয়ানমার চাইবে কোনোভাবে বাংলাদেশকে জড়িয়ে এই স্বীকারোক্তির বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। সেকারণে বাংলাদেশ এ ব্যাপারে কথা না বলাই উত্তম।”
তবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল জ মিন তুন বেনারনিউেজর সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে জানান, তাঁরা আরাকান আর্মির করা ভিডিওটি পর্যালোচনা করে দেখেছেন এবং ভিডিওটি ‘মিথ্যা’ বলে তিনি দাবি করেন।
তিনি বলেন, “সম্ভবত শক্রপক্ষের সেনাদের হাতে ধরা পড়ে মৃত্যুর ভয়ে তারা এই স্বীকারোক্তি দিয়েছে। সামরিক সংঘাতপূর্ণ এলাকায় এমন ঘটনা সবসময়ই ঘটে।”
মেজর জেনারেল জ মিন তুন বলেন, “আমরা আরাকান আর্মির ভিডিওটি তদন্ত করে দেখেছি। আমরা নিশ্চিত করছি, তারা যা বলেছে তা সঠিক নয়।”
তবে ফরটিফাই রাইটস’র মতে, মিও উইন এবং জ নাইংয়ের স্বীকারোক্তি বিশ্বাসযোগ্য। কারণ তাদের স্বীকারোক্তির সাথে রোহিঙ্গাদের সাক্ষ্যের মিল পাওয়া যায়।