মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ‘জাতি নির্মূলে’ চলছে ‘গণহত্যা’
2017.09.11
ঢাকা

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা ‘জাতি নির্মূলে’ একটি ‘গণহত্যা’ চলছে বলে সোমবার মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ও জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা।
এদিকে ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়ভাবে মানবিক সমন্বয়ের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলোর জোট।
“মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি গণহত্যা চলছে। মনে হচ্ছে বার্মিজ সেনাবাহিনী সেখানে রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান শুরু করেছে” বেনারকে বলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক।
সোমবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে সম্প্রতিক আসা শরণার্থীদের সাথে কথা বলে ফিরে এসে তিনি বেনারের কাছে এই মন্ত্যব করেন।
এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জায়েদ রাদ আল হুসেইন সোমবার ‘একটি জাতিকে নিমূর্লের আদর্শ উদাহরণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বলে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়।
“যেহেতু মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের প্রবেশাধিকার দিতে অস্বীকার করেছে, সেহেতু সেখানকার (রাখাইন রাজ্যের) বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতি যাচাই করা সম্ভব নয়, কিন্তু সেখানকার পরিস্থিতি একটি জাতিকে নির্মূলের একটি আদর্শ উদাহরণ বলেই মনে হচ্ছে,” বলেন জায়েদ।
রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকার ধাপে ধাপে আক্রমণ পরিচালনা করছে মন্তব্য করে অবিলম্বে রাখাইনে চলমান ‘ভয়াবহ সামরিক অভিযান’ বন্ধের জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতিও আহ্বান জানান জায়েদ।
এর আগে রোববার রোহিঙ্গা পরিস্থিতির ওপর বিদেশি কূটনৈতিকদের ব্রিফিং শেষে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর ‘গণহত্যা’ চলছে বলে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
“আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলছে এটি গণহত্যা, আমরাও বলব এটি গণহত্যা,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
“হত্যা, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন, ধর্ষণসহ সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সেখানে (রাখাইনে) ঘটছে। এটা অভাবনীয়,” বেনারকে বলেন কাজী রিয়াজুল হক।
এদিকে বার্তা সংস্থা বাসস জানায়, রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্টি, তাদেরকেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে বলে সোমবার সংসদকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
“অবশ্যই মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের নিজ বাসভূমিতে ফেরত নিতে হবে,” বলেন প্রধানমন্ত্রী।
১ লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ
গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) রাখাইনে তল্লাশী চৌকিতে হামলার পর থেকেই মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী রাখাইনে অভিযান শুরু করে। অভিযানের নামে হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগের মুখে প্রাণ বাঁচাতে বিপুল সংখ্যায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসা শুরু করে।
স্থানীয়ভাবে মানবিক সমন্বয়ের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলোর জোট ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) জানায়, সোমবার পর্যন্ত কক্সবাজার ও তার আশপাশের এলাকাগুলোতে এসেছে ৩ লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গা।
এদিকে কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া সমুদ্র সৈকত এলাকা থেকে সোমবার আরো এক রোহিঙ্গা কিশোরীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মঈন উদ্দিন খান।
এই নিয়ে এ পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে নৌপথ পাড়ি দিতে গিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৯০ এ। এছাড়া নাইক্ষংছড়ি ও ঘুমধুম সীমান্তে গুলিবিদ্ধ চারজন রোহিঙ্গার লাশ পাওয়া যায়।
এদিকে গত শনি ও রবিবার বান্দরবানের সীমান্তবর্তী মিয়ানমার অংশে মাইন বিস্ফোরণে তিন রোহিঙ্গা নিহত এবং একজন আহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত ১৮ দিনে মোট ৯১ জন রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে আসেন। যাদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অথবা বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়েছেন।
সম্প্রতি ভারত সরকার সে দেশে বসবাসকারী ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমার ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রবি ও সোমবার ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের দিল্লি, জম্মু ও কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ ও পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভকারীরা রোহিঙ্গাদের ফেরত না পাঠানোর জন্য ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
এদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে দ্বিমত করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার জানিয়েছে, মানবিক কারণে জোর করে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার পাঠাবে না তারা।
জামায়েত-ই ইসলামি হিন্দ-এর প্রেসিডেন্ট মহম্মদ নুরুদ্দিন বেনারকে বলেন, “আমরা দাবি জানাচ্ছি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার প্রতিবাদে আমাদের সরকার সোচ্চার হোন।”
তিনি আরও বলেন, “ভারতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিতাড়নের যে সিদ্ধান্ত ভারত সরকার নিয়েছে তা অবিরম্বে প্রত্যাহার করা হউক।”
ভারতে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সামিল বলে মন্তব্য করেছেন অন্য ১০০টি শরণার্থী পরিবারের সাথে দিল্লির একটি শিবিরে বসবাসকারী সাকির আহমদ।
“মিয়ানমারে, যেখানে সরকারি বাহিনী নির্যাতন করে আমাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবে, সেখানে ফেরত না পাঠিয়ে বরং ভালো হবে যদি ভারত সরকার আমাদের এখানেই মেরে ফেলে,” বেনারকে বলেন সাকির।
এদিকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কেন্দ্রীয় সিন্ধান্তের সাথে দ্বিমত করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর নবান্ন সুত্রে বলা হয়েছে, “রোহিঙ্গারা রাজ্যে থাকতে চাইলে মানবিকতার খাতিরেই তাদের থাকতে দেওয়া হবে। কোনো অবস্থাতেই জোর করে ফেরত পাঠানো হবে না।”
“মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার দেশের মধ্যে সবচেয়ে মানবিক। একটা মানবিক সরকারের পক্ষে যা করা উচিত, আমরা সেটাই করছি,” বেনারকে বলেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
তবে এখন পর্যন্ত ভারতে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কেএস ধাতওয়ালিয়া।
নতুন রোহিঙ্গাদের জন্য জমি বরাদ্দ
নতুন আগত রোহিঙ্গাদের জন্য অস্থায়ী শিবির তৈরি করতে ২ হাজার একর জমি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম।
সোমবার নিজের ফেসবুক পেজে এক পোস্টে তিনি জানান, “কুতুপালং মৌজায় বর্তমান ক্যাম্পের পাশে নতুন করে ২০০০ একর জমি মিয়ানমার থেকে আগতদের জন্য অস্থায়ী আবাস তৈরির জন্য বরাদ্দ দিয়েছে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার।”
প্রসঙ্গত চলতি মাসের চার তারিখ থেকে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের জন্য টেকনাফের পটুবুনিয়ার তিনটি পাহাড়ে নতুন ক্যাম্প নির্মাণ শুরু করেছে সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি)। এছাড়া, উখিয়ার বালুখালি এলাকায় নতুন রোহিঙ্গাদের জন্য জমি খোঁজা হচ্ছে বলেও বেনারকে জানিয়েছেলেন কক্সবাজার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও প্রশাসনের মুখপাত্র খালেদ মাহমুদ।
তবে প্রতিমন্ত্রীর ঘোষিত ২ হাজার একর জমি ইতিমধ্যে নির্মাণ শুরু হওয়া শরণার্থী শিবিরের জমি কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
“এতোগুলো মানুষকে এখানে রাখা আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন বিষয়। কিন্তু মানবিক কারণে আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। তারা তাদের নিজ ভূমিতে ফেরত যাবে এটাই কামনা করছি,” সোমবার সংসদে বলেন প্রধানমন্ত্রী, জানায় বাসস।
এদিকে সোমবার থেকেই নতুন আগত রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রেজিস্ট্রেশন শুরু হচ্ছে বলেও জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
আরসার অস্ত্র বিরতি
দুর্গত রোহিঙ্গাদের কাছে ত্রাণ সরবরাহের সুযোগ দিতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) রোববার নিজেদের পক্ষ থেকে অস্ত্র বিবরিতর ঘোষণা দিয়েছে।
তবে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ‘সন্ত্রাসীদের সাথে’ সমঝোতা করতে রাজি নয় মন্তব্য করে এই অস্ত্র বিরতি প্রত্যাখ্যান করেছে বলে আর্ন্তাজতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়।
“আরসার পক্ষ থেকে ১০ সেপ্টেম্বরের অস্ত্র বিরতির ঘোষণা সত্যিই স্মার্ট। এটি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ‘জাতি নির্মূল’ অভিযানের দিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনযোগ একীভূত রাখতে সহায়তা করবে,” সোমবার বেনারকে বলেন ওয়াশিংটন ভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বেনারনিউজের কলামিস্ট জাকারি আবুজা।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি, কলকাতা থেকে পরিতোষ পাল ও নয়াদিল্লি থেকে আকাশ বশিষ্ঠ।