স্থলমাইনে হতাহত রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসছে

জেসমিন পাপড়ি
2017.09.11
কক্সবাজার
জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে নো ম্যানস ল্যান্ড পার হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসছে দুটি রোহিঙ্গা শিশু। জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে নো ম্যানস ল্যান্ড পার হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসছে দুটি রোহিঙ্গা শিশু। ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ

স্থলমাইন ইস্যুতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কড়া সমালোচনার পর সীমান্ত এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শন করে এ ধরনের বিস্ফোরক থাকার সতত্যা পাওয়া গেছে। স্থল মাইন বিস্ফোরণে হতাহতের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নিশ্চিত না হওয়া গেলেও সীমান্তে নতুন আতঙ্ক এখন প্রাণঘাতি এই বিস্ফোরক।

গত শনি ও রবিবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও রেজু আমতলী সীমান্তবর্তী মিয়ানমার অংশে মাইন বিস্ফোরণে তিন রোহিঙ্গা নিহত এবং একজন আহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক।

বেনারকে তিনি বলেন, “সীমান্তে তিনজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। একজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেলেও তার চিকিৎসা কোথায় চলছে তা জানা নেই।”

মিয়ানমার সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইনে আহত দুই যুবকসহ আরও পাঁচ রোহিঙ্গা চিকিৎসা নিতে গত রোববার রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এরা হচ্ছে; ইউসুফ নবী (২৮), মো. হাসান (২৫), নূর হোসেন (৯), মো. মামুন (২৫) ও ৪০ দিন বয়সী সোহানা।

চিকিৎসকেরা জানান, ইউসুফ ও হাসান সীমান্তে স্থল মাইন বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন। আর শিশু সোহানা হামে আক্রান্ত।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত ১৮ দিনে মোট ৯১ জন রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে আসেন। যাদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অথবা বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়েছেন।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “ল্যান্ড মাইন নিষিদ্ধ করতে যে ১৭টি দেশ চুক্তিবদ্ধ হয়েছে তাতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করলেও মিয়ানমার করেনি। তবে বর্ডারে এভাবে মাইন লাগানো ‘অ্যাগ্রেসিভ’ আচরণ।”

তবে সীমান্তে সাম্প্রতিক কোনো মাইন পোঁতা হয়নি বলে রয়টার্সকে জানায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সূত্র। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী মাইনগুলো সীমান্ত অতিক্রম করে যাতায়াত বন্ধ করতে ৯০ এর দশকে পুঁতে রাখা হয়েছিল, যা অপসারণের চেষ্টা করছে তারা।

তিনটি মাইন উদ্ধার

নাইক্ষংছড়ির তমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার অংশে জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন এলাকা থেকে তিনটি মাইন উদ্ধার করেছে নো-ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। এসব মাইনের ছবি এবং ভিডিও বেনারের কাছে রয়েছে।

বেনারের কাছে থাকা ভিডিও ফুটেজ দেখে টেকনাফ থানার ওসি মাঈন উদ্দিন খান বলেন, “আমার ধারণা এগুলো মাইন।”

নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক পুলিশের কাউন্টার টেররিজমের বোম ডিসপোজাল ইউনিটের একজন বিশেষজ্ঞ বেনারকে বলেন, “এগুলো স্থল মাইন”।

এদিকে নো-ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা যাতে আবারও রাখাইনে ফেরত যেতে না পারে এ জন্যই মিয়ানমার নিজেদের সীমান্তে মাইন পুঁতে রাখছে বলে দাবি করেন ওইদিক থেকে আসা রোহিঙ্গারা।

এই নো ম্যানস ল্যান্ডের পেছনেই মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া। এখনো মাঝে মাঝে এই বেড়া ডিঙিয়ে রোহিঙ্গারা নো ম্যানস ল্যান্ডে প্রবেশ করছে। রোববার ভোরের দিকে আসার পথে কয়েকজন রোহিঙ্গা তিনটি মাইন দেখতে পান। এ সময় তারা মাইনগুলো তুলে সেগুলো ভিডিও করেন। মোবাইলে করা ভিডিও এ প্রতিবেদককে দেন নূর আহমদ নামে এক রোহিঙ্গা।

বাংলাদেশ প্রান্তে টহলরত এক বিজিবি সদস্য ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, সকাল থেকেই শুনছি ওরা তিনটি মাইন তুলেছে। তবে সেগুলো কী করেছে জানি না।

নূর আহমদ অবশ্য বলেন, একটি মাইন দূরে নিয়ে বিস্ফোরণ করানো হয়েছে। বাকি দুটির বিস্ফোরণ ঘটানো হবে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মো. ইসলাম বেনারকে বলেন, “যারা মাইনগুলো দেখতে পায়, তাদের মধ্যে একজন আমার বোনের ছেলে। মাইনগুলোর মুখ মাটির ওপরেই ছিল। রোববার ভোরের আলো ফোটার পরপরই তারা কয়েকজন বর্ডার পেরিয়ে নো ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া পরিবারের কাছে আসার পথে এগুলো দেখতে পায়। কাছাকাছি মিয়ানমার সেনারা না থাকায় তারা সেগুলো তুলে ফেলে।”

সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া ঘেঁষে মাইন ও বিপুল বিস্ফোরক পুঁতে রাখার ঘটনায় মিয়ানমারের কড়া সমালোচনা করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো।

গত ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষে স্থল মাইন পোঁতার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার পথে নো ম্যানস ল্যান্ড এর কাছে দুটি স্থল মাইন দেখতে পান রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার পথে নো ম্যানস ল্যান্ড এর কাছে দুটি স্থল মাইন দেখতে পান রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
বেনারনিউজ
বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী স্থলমাইন পুঁতে রেখেছে-এমন প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। গত শনিবারের আগ পর্যন্ত মাইন বিস্ফোরণে একজন নিহত এবং দুই শিশুসহ তিনজন আহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করে মানবাধিকার ওই সংগঠনটি।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “সীমান্তে মাইন বসানোর ঘটনায় আমরা মিয়ানমারের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছি। এ ছাড়া কূটনৈতিক উপায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”

নিহত তিনজন, আহতরা বাংলাদেশে চিকিৎসাধীন

রোববার ভোরের দিকে বাংলাদেশের ঘুমধুম সীমান্তের বাইশফাঁড়ি এলাকার উল্টো দিকে মিয়ানমার অংশে নো ম্যান্স ল্যান্ডের খুব কাছে মাইন বিস্ফোরণের খবর শুনেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ৩৪ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার (সিও) লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান।

এ পারের স্থানীয় একাধিক জনপ্রতিনিধি জানান, আহত ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ হাসান (৩২)। তিনি বাংলাদেশি।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বেনারকে জানান, রোববার ভোরে হাসান গরু আনতে ওপারে গেলে মিয়ানমার বাহিনীর পুতে রাখা মাইনে তার পা উড়ে গেছে। তিনি বলেন, আরেক নারীর পা উড়ে গেছে। তার নাম-পরিচয় তিনি জানেন না।

এছাড়া ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মাইন বিস্ফোরণে একজন নারীও আহত হন বলে জানান জাহাঙ্গীর আজিজ।

মাইন বিস্ফোরণে আহতরা উখিয়ায় অবস্থিত মেডিসিন স্যানস ফ্রন্টিয়ার্সের (সীমান্তবিহীন চিকিৎসক দল) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলে জানান ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আজিজ।

তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কামরান রেজা চৌধুরী

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।