শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখলেন কূটনীতিকেরা

জেসমিন পাপড়ি
2017.09.13
কক্সবাজার
শরণার্থী শিবির পরিদর্শনকালে রোহিঙ্গা শিশুদের কথা শুনছেন নেদারল্যান্ডস এর রাষ্ট্রদূত লিওনি কুলেনায়ার। শরণার্থী শিবির পরিদর্শনকালে রোহিঙ্গা শিশুদের কথা শুনছেন নেদারল্যান্ডস এর রাষ্ট্রদূত লিওনি কুলেনায়ার। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ

জাতিগত সহিংসতায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দুঃখ দুর্দশা দেখলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কূটনীতিকেরা। এসব নাগরিকদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন তাঁরা।

এদিকে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা বন্ধ ও তাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করে নেবার জন্য বুধবার মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতারেস। পাশাপাশি, রাখাইন রাজ্যে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ।

বুধবার দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে ৪৩ দেশের দূতাবাস প্রধান এবং জাতিসংঘসহ ৪টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান কক্সবাজার জেলার উখিয়ায় কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে পৌঁছান।

“যে রাষ্ট্রগুলিকে এ সমস্যার বিষয়ে ওয়াকিবহাল করানো জরুরি, সেসব রাষ্ট্রের দূতাবাস প্রধানেরাই এখানে ছিলেন। আশা করি তাঁরা তাদের সদর দপ্তরে বার্তাগুলো পৌঁছাবেন যে, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে হবে। সেটাই একমাত্র সমাধান,” বেনারকে বলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিন: জাতিসংঘ মহাসচিবের

রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা বন্ধ ও তাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করে নেবার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতারেস।

জাতিসংঘের ইউএন নিউজ সেন্টার এর ওয়েব সাইটে প্রকাশিতে সংবাদ বিজ্ঞাপ্তিতে বলা হয়, জাতিসংঘের ৭২তম সাধারণ অধিবেশন শুরুর আগে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে এই আহ্বান জানান জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতারেস।

“আমি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে সামরিক অভিযান বন্ধ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং যারা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে তাদের ফিরে আসার অধিকার স্বীকার করে নেবার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি,” বলেন গুতারেস।

রাখাইন রাজ্যে “মানবাধিকার পরিস্থিতি দুর্বিসহ” বলে মন্তব্য করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিও আহ্বান জানান তিনি।

বার্তাসংস্থা এএফপি জানায়, রাখাইন রাজ্যে ‘জাতি নির্মূলের’ ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “যেখানে রোহিঙ্গাদের তিন ভাগের একভাগ মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, সেখানে এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার জন্য অন্য কোনো শব্দ কি আছে?”

এদিকে মিয়ানমারের বন্ধুরাষ্ট্র চীনসহ ১৫ সদস্যের জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বুধবার এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে এক যৌথ বিবৃতিতে মিয়ানমারের প্রতি ‘অবিলম্বে’ রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে, জানায় বার্তাসংস্থা এএফপি।

বাংলাদেশের জন্য সহায়ক

বাঁশ আর পলিথিনের তৈরি ঘরে কোনো রকমে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কাছে ছুটে গিয়ে তাদের কথাও শোনেন কূটনীতিকেরা। এ সময় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান তাদের ওপর চালানো নির্যাতন আর ধ্বংসযজ্ঞের কথা।

রোহিঙ্গাদের দুঃখ-কষ্ট বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা সরাসরি প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে তাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি সহজ হবে বলে মনে করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

তিনি বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের আচরণে মানবতার যে ক্ষতি হচ্ছে এবার তা তারা স্বচক্ষে দেখছেন। আমাদের কূটনীতিক তৎপরতায় এটা সহায়ক হবে।”

কূটনীতিকরা শিবিরে প্রবেশ করার সময় লম্বা লাইন ধরে রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করতে দেখেন। এ বিষয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথাও বলেন তারা।

পরে জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন রোহিঙ্গা পরিস্থিতি বিষয়ে কূটনীতিকদের ব্রিফিং করেন।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকসহ প্রতিনিধি দলে, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নরওয়ে, পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নেপাল, ওমান, ইরান, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, সৌদি আরব, উত্তর কোরিয়া, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা ছিলেন।

মিয়ানমারে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখলেন তাঁরা

কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন শেষে কূটনীতিকেরা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্ত পরিদর্শন করেন। এই সীমান্তের কয়েক গজ দূরেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। রাখাইনের সীমানার কাঁটাতার পেরিয়ে নো-ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থান নিয়েছে প্রায় ১০ হাজার মানুষ। ছোট্ট একটি খালের এপার থেকে তাদেরও দেখলেন কূটনীতিকেরা।

সেখানে টহলরত বিজিবি সদস্যরা জানালেন, মিয়ানমার সীমান্তে দেশটির নিরাপত্তারক্ষীদের পোঁতা স্থল মাইন সদৃশ বোমা বিস্ফোরণে লোকজন হতাহত হচ্ছেন।

এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে ৩৪ বিজিবির’র লে. কর্নেল মঞ্জুর হাসান খান বেনারকে বলেন, “আমরা দেখেছি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বা সীমান্তরক্ষী বাহিনী টহল দেওয়ার সময় মাইন পুতে রেখে যায়।”

এদিকে কূটনীতিকরা সীমান্ত পরিদর্শন শেষে কক্সবাজার ফেরার জন্য গাড়িতে ওঠার সময় নাফ নদীর ওপারে রাখাইনের একটি গ্রামে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। বিস্মিত কূটনীতিকরা আবারও গাড়ি থেকে নেমে এ দৃশ্য ভিডিও ধারণ করতে থাকেন।

মানবতার সংকটের সমাধান চাইলেন

সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নেদারল্যান্ডস এর রাষ্ট্রদূত লিওনি কুলেনায়ার রোহিঙ্গা পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “এখানে মানবতা আক্রান্ত। এটি চলতে পারে না। এর একটি রাজনৈতিক সমাধান হওয়া জরুরি।”

বৃটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেইক বলেন, “এখানে মানবতা কীভাবে সংকটে রয়েছে তা আমরা দেখেছি। আমরা চাই এই সংকটের সমাধান হোক।”

ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা বলেন, “রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ফেরত যাওয়ার সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।”

রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে অংশীদার হিসাবে বাংলাদেশের পাশে থাকার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন মার্কিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জোয়েল রিফম্যান। তিনি বলেন, “আমরা মানবতার এ সংকটের সমাধান চাই।”

মিয়ানমারে অন্যতম বন্ধু রাষ্ট্র চীনের রাষ্ট্রদূত মা মিং কিয়াংয়ের কাছে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখার পরে তার মূল্যায়ন জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে চীনও এ সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।”

রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া সম্পর্কিত বেনারের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা মিয়ানমারেরও বন্ধু, বাংলাদেশেরও। সমাধান হতে হবে, সমাধান আছে বলেই মনে করি।”

আরও ১০ লাশ উদ্ধার

এদিকে টেকনাফ উপজেলায় নাফ নদী থেকে আরও ১০জন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত এসব লাশ উদ্ধার করা হয়।

“বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় কোনো নৌকাডুবির ঘটনায় তাদের মৃত্যু হয় বলে আমরা ধারণা করছি,” বেনারকে বলেন, টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাইন উদ্দিন খান।

এই নিয়ে গত ২৫ আগস্টের পর থেকে কক্সবাজার ও বান্দরবানের বিভিন্ন স্থানে ১০২ জন রোহিঙ্গার লাশ পাওয়া গেল।

জাতিসংঘের হিসাবে, গত ২৫ আগস্টের পর থেকে বুধবার পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৩ লক্ষ আশি হাজার।

ইন্দোনেশিয়ার ত্রাণ

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য ৩৪টান চাল, শুকান খাবার, পানির ট্যাংক, তাবু শিশুদের পোশাক, কম্বল ও অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে বুধবার চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে চারটি কার্গো প্লেন পাঠিয়েছে ইন্দোনেশিয়া।

“আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার পাঠিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে সেখানে কী ধরনের মানবিক সহায়তা দরকার তা জানার পর আমরা এই সামগ্রীগুলো পাঠাচ্ছি,” ত্রাণবাহী বিমানকে বিদায় জানানোর সময় সাংবাদিকদের বলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জকো ইউডোডো।

এর আগে মঙ্গলবার জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের পক্ষ থেকেও রোহিঙ্গাদের জন্য জরুরি ত্রাণবাহী বিমান বাংলাদেশে পৌঁছায়।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জাকার্তা থেকে ইসমিরা লুৎফিয়া।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।