পানি ও স্যানিটেশন সংকটে রোহিঙ্গা শিবিরে ছড়াচ্ছে অসুখ

জেসমিন পাপড়ি
2017.09.14
কক্সবাজার
উখিয়ার কুতুপালং শিবিরে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের পানি খাওয়াচ্ছেন একজন পুরাতন রোহিঙ্গা নারী। উখিয়ার কুতুপালং শিবিরে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের পানি খাওয়াচ্ছেন একজন পুরাতন রোহিঙ্গা নারী। সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৭।
জেসমিন পাপড়ি/বেনার নিউজ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জাতিগত সহিংসতা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেবার পর তীব্র পানির সংকট ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাবে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা।

স্বাস্থ্যকর্মীদের আশঙ্কা, দ্রুত সুপেয় পানি এবং স্যানিটেশনের ব্যবস্থা না করা গেলে ডায়ারিয়াসহ বিভিন্ন রোগ মহামারি আকার ধারণ করতে পারে।

তমব্রু সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন ডা. আবদুস সামাদ ও ডা. সাজিদ হাসান সৌরভ।

গত রোববার ডা. সামাদ বেনারকে বলেন, “এখন পর্যন্ত যত রোগী দেখেছি, তাদের ৮০ শতাংশ শিশু এবং এসব শিশুর ৯০ শতাংশ ডায়রিয়া এবং জ্বরে আক্রান্ত।”

রোববার সকাল থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত তাঁরা আড়াইশ রোগী দেখছেন বলে বেনারকে জানান।

এদিকে বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রসের (আইসিআরসি)।

আইসিআরসির মেডিকেল ফিল্ড অফিসার ড. কেএম আবদুল্লাহ আল মাসুদ বুধবার বেনারকে বলেন, “সুপেয় পানির অভাব আর যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগের কারণে দূষিত হয়ে যাওয়া পরিবেশ এসব রোগের জন্য দায়ী।”

তিনি জানান, “গত কয়েকদিনে আমাদের মেডিকেল টিম প্রায় তিন হাজার রোগীকে সেবা দিয়েছে। যাদের মধ্যে ডায়ারিয়া ও জ্বরে আক্রান্ত রোগি পাওয়া গেছে।”

দ্রুত সুপেয় পানি এবং স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করতে না পারলে এসব রোগ মহামারি আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

তাছাড়া প্লাস্টিকের তৈরি ছাপড়ায় অতিরিক্ত গরমও বিভিন্ন রোগের জন্ম দিচ্ছে বলে মত দেন ড. কেএম আবদুল্লাহ।

পানির অভাব তীব্র

গত কয়েকদিনে বিভিন্ন বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবির, সীমান্ত এলাকা, নো-ম্যানস ল্যান্ডসহ বেশ কিছু এলাকা ঘুরে পানি ও স্যানিটেশনের তীব্র সংকটের বিষয়টি লক্ষ করা গেছে।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার হিসেবে ২৪ আগস্টে পরে রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর মাত্র তিন সপ্তাহে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের পাশে, কুতুপালং থেকে শুরু করে বালুখালী এলাকা পেরিয়ে কয়েক কিলোমিটার এলাকার বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁপড়ি গড়ে তুলেছে রোহিঙ্গারা।

শরণার্থীদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সুপেয় পানির অভাব। এসব এলাকায় টিউবওয়েল না থাকায় বালুখালি শরণার্থী ক্যাম্পের বাইরে সড়কের পাশে তিনটি প্লাস্টিকের ট্যাংকে ‘নিরাপদ খাবার পানি’র ব্যবস্থা রেখেছে দাতা সংস্থাগুলো। এগুলোর ধারণ ক্ষমতা ১২০০ লিটার করে, যা দিয়ে কয়েক হাজার মানুষের চাহিদা মেটানো নিতান্তই দুঃসাধ্য।

অনেকের কাছে পানি সংগ্রহ করার মতো পাত্রও নেই। শিশুরা অনেক সময় সামনের খাল বা জমি থেকে পানি খেয়ে ফেলে বলে জানান নুরুল হাকিম নামের একজন শরণার্থী।

“ঘরে নয়জন মানুষ। অথচ পানি আনার জন্য একটি বোতল আছে। অনেক দূর থেকে আনা পানি কয়েক ঢোক করে সবাই মিলে খাই,” বেনারকে বলেন ২১ বছর বয়সী শরণার্থী রুবাইদা।

উখিয়ার রাস্তার পাশে আশ্রয় নেওয়া এ পরিবারের সাত শিশুর পাঁচজনই ডায়রিয়া এবাং জ্বরে আক্রান্ত। সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৭।
উখিয়ার রাস্তার পাশে আশ্রয় নেওয়া এ পরিবারের সাত শিশুর পাঁচজনই ডায়রিয়া এবাং জ্বরে আক্রান্ত। সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৭।
জেসমিন পাপড়ি/বেনার নিউজ

দুর্গন্ধময় পরিবেশে বসবাস

বাঁশ আর প্লাস্টিকের তৈরি ঝুঁপড়িতে কোনো রকমে বাস করা গেলেও সেখানে টয়লেটের কোনো ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিরাট সংখ্যক মানুষ যেখানে সেখানে মল-মূত্র ত্যাগ করায় পুরো এলাকা জুড়ে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে।

সবেচেয়ে বেশি সমস্যায় রয়েছেন রোহিঙ্গা নারীরা। কুতুপালং নিবিন্ধত শিবির এলাকার পার হওয়ার পরেই টেলিভিশন কেন্দ্র এলাকার সরকারি বনভূমিতে আশ্রয় নিয়েছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা। সেখানকার একটি ঝুঁপড়িতে বসবাস করেন মনোয়ারা বেগম (২৫)।

রাখাইনের বুচিদং জেলার তমবাজার এলাকার এই নারী চারদিন আগে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন।

তিনি বেনারকে বলেন, “চার দিন গোসল করিনি। টয়লেটে যাওয়াও সম্ভব হয় না। শুধু কাপড় পাল্টে দিন চলে। বাচ্চাদেরও একই অবস্থা। প্লাস্টিকের ঘরে অত্যন্ত গরম আর গোসল না করতে পারায় আমার দুই সন্তান জ্বরে ভুগছে। তাদের শরীরে চুলকানিও হচ্ছে।”

মরিয়মের ঝুপড়িতে আশ্রয় নিয়েছে তিনটি পরিবার। সব মিলিয়ে এখানে শিশুর সংখ্যা আটজন। তাদের মধ্যে পাঁচজনই জ্বরে আক্রান্ত। এদের দুজনের আবার জ্বরের সঙ্গে ডায়ারিয়াও শুরু হয়েছে।

মরিয়মের ঘর থেকে বেরিয়ে কিছুদূর এগুতেই দেখা হয় মো. আমিনুলের সঙ্গে। পাঁচদিন আগে ১২জন মিলে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি জানান, আটদিন ধরে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে আসতে পেরেছি। এখানে খাবার পানি পাই না। ইতিমধ্যে আমার দুটি ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”

মো. সিরাজ সামনের এক কিলোমিটার এলাকা দেখিয়ে বলেন, “এই জায়গাতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু কোনো টয়লেটের ব্যবস্থা করা যায়নি। ফলে যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করছে এসব মানুষ। যার কারণে পুরো এলাকায় তীব্র দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে।”

সিরাজ যে তীব্র গন্ধের কথা বলছিলেন, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যাওয়ার পথে উখিয়া বাজার পার হওয়ার একটু পরেই দুর্গন্ধটা নাকে আসতে থাকে। এরপর যত এগিয়ে যাওয়া যায়, এই দুর্গন্ধের তীব্রতা ততই বাড়তে থাকে।

রোহিঙ্গা শিবিরে ঢুকে পা ফেলতে হয় খুব সাবধানে। কারণ বিভিন্ন স্থানেই মানুষের মল দেখতে পাওয়া যায়। তার পাশেই পরিবারগুলো বসবাস করছে।

“শরণর্থীর সংখ্যা এত বেশি যে আমাদেরকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এখনও তাদের জন্য সকল ব্যবস্থা দিতে পারেনি। তবে সবাই মিলে আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে,” বেনারকে বলেন কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিষয়ক সংস্থার (আইওএম) এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মুখপাত্র ক্রিস লম।

তবে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন বেনারকে বলেন, “সরকারের নির্ধারিত স্থানে শেড নির্মাণের কাজ চলছে। গত কয়েকদিনে আমরা ১০ হাজারের বেশি শেড নির্মাণ করেছি। একেকটি শেডে ৮০টি পরিবার আশ্রয় নিতে পারবে। সেখানে পর্যাপ্ত নলকূপ ও টয়লেটের ব্যবস্থাও রয়েছে।”

“আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের এই নির্দষ্ট স্থানে আনার চেষ্টা চলছে। এর মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।