ত্রাণের জন্য মরিয়া রোহিঙ্গারা, ব্যবস্থাপনায় হিমশিম অবস্থা
2017.09.15
কক্সবাজার

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতা থেকে বাঁচতে মাত্র তিন সপ্তায় চার লাখ শরণার্থী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করায় কোন স্থানে কত রোহিঙ্গা রয়েছে সে বিষয়ে এখনো কোনো ধারণায় পৌঁছাতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।
বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন সড়ক আর পাহাড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন রোহিঙ্গারা। ফলে জরুরি সহায়তা পৌঁছাতে যেমন হিমশিম খেতে হচ্ছে সংস্থাগুলোর, তেমনি ঘটছে মৃত্যুর মতো দুর্ঘটনা, আবার অনেকেই থেকে যাচ্ছেন সম্পূর্ণভাবে ত্রাণ সহায়তার বাইরে।
“আমরা রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে থাকায় এখানে তেমন সাহায্য পৌঁছায় না,” বেনারকে বলেন কক্সবাজার-টেকনাফ প্রধান সড়ক থেকে বেশ কিছুটা দূরে বালুখালী খালের পাড়ে আশ্রয় নেওয়া আমিনা বেগম (৪৬)।
রাখাইন রাজ্যে মিলিটারির গুলিতে দুই জোয়ান ছেলেকে হারিয়ে টানা আটদিন পায়ে হেঁটে দু’দিন আগে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন এই রোহিঙ্গা নারী।
“কিছুক্ষণ আগে দুদিনের মধ্যে প্রথমবারের মত ১৫০ টাকা সাহায্য পেয়েছি। সে টাকা দিয়ে এক ছেলেকে বাজারে পাঠিয়েছি। আজ আশা করি সবাই মিলে ভাত খাব,” বলেন আমেনা।
ত্রাণ পাওয়ার অপেক্ষায় টেকনাফ সড়কের উপরে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করছিল শিশু নূর কাশেম (১০)। ত্রাণের গাড়িগুলোর পিছু পিছু ছুটলেও ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারায় দুপুর ১২টা পর্যন্ত কোনো ত্রাণই সংগ্রহ করতে পারেনি সে।
কাছে গেলে সে জানায়, অল্প ভাত ছিল, সকালে তা চার ভাই বোন মিলে শুকনো মাছ দিয়ে খেয়েছে। ছোটদের পলিথিনের ঘরে রেখে রাস্তায় এসেছে ত্রাণের আশায়।
“দেখুন, বাংলাদেশ এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে কয়েক লক্ষ মানুষের থাকা, খাওয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেওয়া মোটেই সহজ বিষয় নয়। তারপরেও আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি,” বেনারকে বলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
দু’এক সপ্তাহের মধ্যেই পরিস্থিতি বদলাবে বলে মনে করেন তিনি।
ত্রাণ নিতে গিয়ে বিশৃঙ্খলা, মৃত্যু
কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যেতে উখিয়া বাজারের পর থেকে বালুখালি, কুতুপালংয়ের পেরিয়ে প্রায় ১৫-২০ কিলোমিটার সড়কের পাশে এবং বিভিন্ন পাহাড়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন।
বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংগঠনের অসংখ্য গাড়ি প্রতিদিন বিচ্ছিন্নভাবে ত্রাণ দিতে আসলেও সংগঠিতভাবে ত্রাণ দেওয়ার তেমন কোনো তৎপরতা এখনও শুরু করা যায়নি।
বিচ্ছিন্নভাবে ত্রাণ না দিয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ত্রাণ জমা করার আহবান জানানো হলেও এখনো সেভাবে সাড়া মেলেনি বলে জানান উখিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাঈদ উদ্দিন।
সরেজমিনে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রাস্তায় কোনো একটি ত্রাণের গাড়ি এসে থামলেই রোহিঙ্গারা চারদিক থেকে সেটা ঘিরে ফেলে। ফলে টেকনাফের এই সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
“ভিতরের দিকে কোনো ত্রাণ যায় না। কিছুই খেতে পাই না। রাস্তায় আসা ট্রাক থেকে যদি কিছু পাওয়া যায় এই আশায় এখানে এসেছি,” বেনারকে বলেন রাখাইনের আকিয়াব থেকে আসা আবদুল হামিদ।
আবদুল হামিদ ১৫দিন আগে বালুখালি পাহাড়ের ভেতরে আবাস গড়লেও ত্রাণের আশায় দু’দিন আগে বালুখালি বাজারের পাশের নতুন বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানান।
এদিকে রাস্তায় রাস্তায় ত্রাণ দেওয়ার জন্য সড়কে দীর্ঘ জ্যামের যেমন সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি ত্রাণ নিতে গিয়ে গাড়ির তলায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
“গতকাল ত্রাণ নেওয়ার সময় একজন রোহিঙ্গা বৃদ্ধ মারা গেছেন,” বেনারকে বলেন উখিয়া থানার অফিসার ইন চার্জ কিসনু চাকমা।
শনিবার থেকে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ১০ জনের একটি টিম কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কে কাজ করার পাশাপাশি তিনজন অতিরিক্ত সুপার ও চারচজন সহকারী পুলিশ সুপার ট্রাফিক ব্যবস্থা মনিটরিং করবেন বলে জানান তিনি।
“এছাড়া এ মহাসড়কের পাশে নির্মিত শেডগুলো উচ্ছেদ করে নির্ধারিত স্থানে স্থানান্তরিত করা হবে। এ কাজে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সাতটি টিম কাজ করবে,” বেনারকে বলেন কিসনু চাকমা।
ত্রাণ আসছে, রয়েছে মজুত
এক সংবাদ সম্মেলনে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন বলেন, “সরকারি ত্রাণ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে এখন পর্যন্ত আটশ মেট্রিক টন খাবার সামগ্রী ও নগদ ৩২ লক্ষ টাকা জমা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ লাখ প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব তহবিল ও ১০ লাখ ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের তহবিল থেকে। বাকি ১২ লাখ টাকা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এসেছে।”
বান্দরবান পার্বত্য জেলার সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আজিজুর রহমান বেনারকে জানান, বান্দরবান জেলায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। তাদের নাম নিবন্ধন চলছে। শেষ হলে সবাইকে উখিয়ায় সরকারের নির্ধারিত স্থানে পাঠানো হবে।”
মিয়ানমারের রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরু হলে গত ২৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো।
এসব রোহিঙ্গাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন। ইতিমধ্যে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা (ইউএনএইচসিআর), ইউনিসেফ, ইন্দোনেশিয়া, ভারত এবং মরোক্কো সরকারের পাঠানো ত্রাণ সামগ্রী বাংলাদেশে পৌঁছেছে। চীনও রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে।
এদিকে স্থানীয় বাসিন্দা আলাল হোসেন বেনারকে জানান, এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের থাকা- খাওয়ার মতো চিকিৎসা ব্যবস্থা একেবারেই প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত।
তবে বিভিন্ন জায়গায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের বেশ কিছু মেডিকেল ক্যাম্প দেখা যায়। এসব স্থানে জ্বর, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া আর ছোটখাটো কাটাছেড়ার চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।