আবারও আকাশ সীমা লঙ্ঘন করল মিয়ানমার, ঢাকার কড়া প্রতিবাদ
2017.09.15
কক্সবাজার

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ড্রোন ও হেলিকপ্টার আকাশসীমা লঙ্ঘন করায় এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। উসকানিমূলক এই তৎপরতা দুই দেশের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে বলেও হুঁশিয়ার করা হয়েছে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকায় মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত অং মিন্টকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এই প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনুবিভাগের মহাপরিচালক মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “গত ১০, ১২, ১৪ তারিখে মিয়ানমার আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। আজও (শুক্রবার) হয়েছে। আজ দুইবার এবং ১০ সেপ্টেম্বর দুইবার, ১২ সেপ্টেম্বর তারিখে একবার এই সীমা লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমার।”
“আসলে সংখ্যাটা বড় না। বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, এটাই বড় ব্যাপার,” বলেন তিনি।
তবে এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে শুক্রবারের বিষয়টি উল্লেখ নেই। বিজ্ঞপ্তিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, “১০, ১২ ও ১৪ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের ড্রোন ও হেলিকপ্টার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘনের প্রতিবাদে অং মিন্টের হাতে একটি প্রতিবাদপত্র তুলে দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনু বিভাগ) মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরী।”
“প্রতিবাদপত্রে গত ২৫ আগস্টের পর থেকে আকাশসীমা লঙ্ঘনের বিষয়টি তুলে ধরে বাংলাদেশ এ ধরনের উসকানিমূলক তৎপরতায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে। সার্বভৌমত্ব বিনষ্টের এ ধরনের তৎপরতা ভবিষ্যতে যাতে না হয়, সে জন্য জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে বলেছে,” বলেন তিনি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এ ধরনের উসকানিমূলক তৎপরতা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে বলেও উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ।
মিয়ানমারের দুই সাংবাদিক আটক
এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের মধ্যেই মিয়ানমারের ছয়জন গুপ্তচরকে আটক করার দাবি বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের মধ্যে দুজন সাংবাদিক বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি রণজিৎ কুমার বড়ুয়া।
তিনি বলেন, “পাঁচ দিন আগে টুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ করার অভিযোগে মিয়ানমারের দুজন সাংবাদিককে আটক করা হয়। তাদের কাছে সাংবাদিকের পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে। দেশের অভিবাসন আইন ভঙ্গ করায় এই দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তাঁরা এখন কারাগারে রয়েছে।”
রণজিৎ বড়ুয়া জানান, “এরা বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।”
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মঞ্জুরুল করিম বলেন, “বেশ কয়েক দিন আগে মিয়ানমারের সাংবাদিক আটক হওয়ার খবর পুলিশের কাছে শুনেছি।”
বাংলাদেশ তাদের গুপ্তচর মনে করছে কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “যেটা আপনি বললেন (গুপ্তচর) সেটা হওয়া খুব স্বাভাবিক। নানাভাবেই ওরা (মিয়ানমার) ভেতরে ঢুকে তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করছে।”
জানা যায়, আটককৃতরা হলেন; জার্মানি ভিত্তিক জিইও ম্যাগাজিনের আলোকচিত্রী মিনজাইয়ার এবং তার সহকারী হকুন লাট।
এক বিবৃতিতে জিইও জানায়, গত ৭ সেপ্টেম্বর তাদের আটক করা হলেও এখনো জামিন দেওয়া হয়নি। মিনজাইয়ার একজন পুরস্কারজয়ী আলোকচিত্রী বলেও এতে জানানো হয়।
আরও চার রোহিঙ্গা গুপ্তচর আটক
এদিকে বান্দরবান জেলা সংলগ্ন মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকা থেকে মঙ্গল ও বুধবার চারজন রোহিঙ্গা গুপ্তচরকে আটক করেছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)।
তারা রোহিঙ্গা হলেও মিয়ানমার সরকারের হয়ে কাজ করছিল বলে নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ সরকার।
এ প্রসঙ্গে বান্দরবান পার্বত্য জেলার সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আজিজুর রহমান বেনারকে জানান, “জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির চাকঢালাই এলাকা থেকে গত কয়েক দিনে মিয়ানমারের চারজন গুপ্তচরকে আটক করা হয়। প্রথমে দুজনকে আটকের পরে রিমান্ডে নেওয়া হলে তারা আরও দুজনের নাম ও অবস্থান জানায়। পরে গতকাল রাতে ওই দুজনকেও আটক করা হয়।”
“তারা রোহিঙ্গা মুসলিম। বেশ আগেই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। তবে তারা মিয়ানমার সরকারকে তথ্য সরবরাহ করে থাকে,” বলেন তিনি।
এখন তারা বিজিবি’র নাইক্ষ্যংছড়ি ব্যাটালিয়নের হেফাজতে রয়েছে বলে জানান আজিজুর।
অ্যামনেস্টির অভিযোগ অস্বীকার মিয়ানমারের
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের গ্রাম পোড়ানোর স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পাওয়া ছবি প্রকাশ করে দেশটির বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিতভাবে এই অভিযান চালানোর অভিযোগ তুলেছে। তবে সে অভিযোগ অস্বীকার করেছে মিয়ানমার।
অ্যামনেস্টি বলছে, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পাওয়া ছবি, অগ্নিসংযোগের তথ্য, ভিডিও, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রমাণ হয় যে, মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনী সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের দেশটি থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করছে।
তবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দাবি, তারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বেসামরিক নাগরিকদের এ অভিযানের লক্ষ্যবস্তু করার বিষয়টি অস্বীকার করেছে তারা।
প্রসঙ্গত, রাখাইনে সেনা অভিযানের মুখে গত ২৫ আগস্ট থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ৩ লাখ ৯১ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলকে মিয়ানমারের ‘না’
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তরের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাট্রিক মার্ফি’কে মিয়ানমারে পাঠাতে চাইলেও তাকে উপদ্রুত এলাকায় যেতে দেবে না বলে জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার।
বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং লিনকে তলব করে রাখাইনের সহিংসতায় উদ্বেগ জানায় যুক্তরাষ্ট্র। এ সময় প্যাট্রিকের নেতৃত্বে মার্কিন প্রতিনিধি দলের মিয়ানমার সফরের কথাও জানানো হয়।
তবে বার্তা সংস্থা রয়টার্স রাখাইন রাজ্য সরকারের সচিব টিম মং সুয়ে’কে উদ্ধৃত করে শুক্রবার জানায়, রাখাইনের সহিংসতা কবলিত এলাকাগুলোতে প্যাট্রিক মার্ফিকে যেতে দেওয়া হবে না। তিনি কেবল ইয়াঙ্গুনে স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচিসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
এ ছাড়া রাখাইনের রাজধানী সিত্তে গিয়ে গভর্নরের সঙ্গেও বৈঠক করবেন প্যাট্রিক।
বাংলাদেশে বিক্ষোভ
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন ও গণহত্যা চালানো এবং তাদেরকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করার প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে ধর্মভিত্তিক বেশ কয়েকটি ইসলামি দল ও সংগঠন। শুক্রবার জুমার নামাজের আগে ও পরে এ বিক্ষোভ সমাবেশ করে তারা। এসময় তারা দেশটির নেত্রী অং সান সু চির কুশপুত্তলিকায় আগুন দিয়েছে।
মিয়ানমার সরকারে গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধ করতে সামরিক ব্যবস্থা নিতে বিশ্বনেতাদের আহবান জানান ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ নেতা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ।
বিক্ষোভ সমাবেশে ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের আমির মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিজ দেশের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করার দাবি জানান।
বাংলাদেশে বৌদ্ধদের নিরাপত্তা জোরদার
মিয়ানমারে মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়নের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা হুমকি পাচ্ছেন এমন অভিযোগ পাওয়ার পরে রাজধানী ঢাকার বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে নিরাপত্তা বাড়িয়েছে পুলিশ।
“ঢাকার মেরুল বাড্ডা, বাসাবো, উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টর, নর্দা, মিরপুর এবং আশুলিয়ার বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে পুলিশ নিরাপত্তা দিচ্ছে বলে সাংবাদিকদের জানান বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অশোক বড়ুয়া।
তবে আপাতত বড় ধরনের কোনো আশঙ্কা নেই বলেও মনে করেন তিনি।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজ অভিযোগ করে, রোহিঙ্গা সংকটকে পুঁজি করে কিছু মহল এ দেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন হুমকি দিচ্ছে।