সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে
2020.09.15
ঢাকা
বাংলাদেশ সরকারের রোহিঙ্গা বিষয়ক নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় শরণার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা উচিত বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
এ বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোয় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের অবশ্যই তাদের জীবনে প্রভাব সৃষ্টি করা সিদ্ধান্তে অংশ নেওয়ার এবং নিজেদের পক্ষে কথা বলার অধিকার দিতে হবে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি জানিয়েছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অংশ না নেওয়ায় তাদের মত প্রকাশ, সমাবেশ ও চলাফেরার স্বাধীনতা এবং স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার অধিকারের মতো মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
জানতে চাইলে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন (আরআরআরসি) কমিশনার মাহবুব আলম তালুকদার বেনারকে বলেন, “অ্যামনেস্টি বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের মতামত না নেওয়ার কথা বলতে পারছে। অথচ যে দেশটি (মিয়ানরমার) রোহিঙ্গাদের মেরে–কেটে ও ধর্ষন করে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো আওয়াজ নেই। কেন?”
“বাংলাদেশ সরকার কি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে ভুল করেছে নাকি?” প্রশ্ন তোলেন এই কর্মকর্তা।
অ্যামনেস্টির মহাসচিবের কার্যালয়ের পরিচালক ডেভিড গ্রিফিথস বলেন, “যদিও বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তায় অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে তাদের সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে যা রোহিঙ্গাদের পুরোপুরি সম্পৃক্ত না করেই নেওয়া হয়।”
“যা প্রয়োজন তা হলো; একটি সুস্পষ্ট নীতি, যেটা মানবাধিকার সঠিকভাবে সুরক্ষিত হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে রোহিঙ্গাদের মতামতকে অন্তর্ভুক্ত করবে,” যোগ করেন তিনি।
শরণার্থী ও অভিবাসন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীরের ধারণা, নিশ্চয়ই এ বিষয়ে সরকার কোনো কর্মপন্থা নির্ধারণ করবে, যাতে ভবিষ্যতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ বিষয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে।
“এটা তাদের প্রত্যাবাসনের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,” উল্লেখ করে বেনারকে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা বিষয়ক প্রতিটি পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্তের ব্যাপারে শরণার্থীদের আস্থা অর্জনের বিষয়টি সবচেয়ে জরুরি।”
কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারের রাখাইনে নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়ে লাখ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে উল্লেখ করে অ্যামনেস্টির ডেভিড বলেন, “বাস্তুচ্যুত হওয়ার তিন বছর পরেও তারা এখনও ভুগছে এবং নিজেদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে বাঁধা পাচ্ছে।”
নিজেদের ওয়েবসাইটে ‘আসুন আমরা আমাদের অধিকারের জন্য কথা বলি’ শীর্ষক প্রতিবেদন এবং এ বিষয়ক বিবৃতিটি প্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি।
প্রসঙ্গ ৩০৬ রোহিঙ্গা
গত মে মাস থেকে ভাসানচরে অবস্থান করা ৩০৬ রোহিঙ্গাকে এখন পর্যন্ত কক্সবাজারে ফিরিয়ে না আনায় সরকারের সমালোচনা করেছে সংস্থাটি।
তাদের দাবি, ওই দ্বীপে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এতদিন বন্দী রেখে আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক চুক্তির নয় ও ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছে বাংলাদেশ।
একই দিন পৃথক বিবৃতিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভাসানচরে না রাখার প্রতিশ্রুতির সম্মান রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
এ নিয়ে আলাপকালে আরআরআরসি বলেন, “বাংলাদেশ সরকার এত কষ্ট করে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর দেখভাল করছে, তবুও তারা (আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো) শুধু আমাদের ত্রুটিই খুঁজে বেড়াচ্ছে।”
ভাসানচরে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকার কথাও তিনি বেনারকে জানিয়েছেন।
ভাসানচর সম্পর্কে অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি কারাগারের চেয়েও খারাপ্। সেখানে বসবাস করা ও সফর করা রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে থাকা, খাওয়া ও চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।
ভাসানচরের বাসযোগ্যতা নিয়ে জাতিসংঘ এখনও তার মূল্যায়ন জানায়নি উল্লেখ করে সংস্থাটির কর্মকর্তা ডেভিড বলেন, “বাংলাদেশ সরকারের উচিত ভাসানচর থেকে সব রোহিঙ্গাকে নিরাপদে কক্সবাজারের ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনা।”
এইচআরডব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড এ্যাডামস মনে করেন, প্রত্যন্ত দ্বীপটিকে নিরাপদ ও বাসযোগ্য প্রমাণের চেষ্টায় ওই শরণার্থীদের তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় সেখানে আটকে রেখেছে সরকার।
“কেবল জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘ-প্রতিশ্রুত স্বতন্ত্র মূল্যায়ন করার অনুমতি দিয়েই ভাসানচরের আবাসন ব্যবস্থার সম্ভাব্যতা, সুরক্ষা এবং স্থায়িত্ব নির্ধারণ করা সম্ভব হবে,” বলেন তিনি।
“সরকারের উচিত এ ব্যাপারে খুব দ্রুত স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা,” বলেন আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সাবেক কর্মকর্তা আসিফ মুনীর। সেখানে আরো রোহিঙ্গা প্রতিনিধি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের নিয়ে যাওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
আসিফ আরো বলেন, “সঙ্গনিরোধের কথা বলে ভাসানচরে নিয়ে এভাবে তাদের আটকে রাখার ঘটনা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি রোহিঙ্গাদের বিশ্বাসহীনতা বাড়াতে পারে।”
এদিকে ভাসানচরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের শ্রমিক, এমনকি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যৌন হয়রানি ও নির্যাতন করছে বলে দাবি করেছে অ্যামনেস্টি।
ভাসানচরে এমন ঘটনা ঘটার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই— এ কথা উল্লেখ করে নোয়াখালীর হাতিয়া সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার (এএসপি) গোলাম ফারুক বেনারকে বলেন, “বাস্তবতা হচ্ছে রোহিঙ্গারা সেখানে হয়তো থাকতে চায় না। তাই এ ধরনের মিথ্যা অভিযোগ করতে পারে।”
ভাসানচরে একই কক্ষে বাস করছেন রোহিঙ্গা নারী আসমা বেগম (১৮), হালিমা খাতুন (১৮) ও আনোয়ারি জান (২০)। মুঠোফোনে তারা বেনারকে জানান, প্রায়ই তাদের উদ্দেশ্যে করে আজেবাজে মন্তব্য করেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। তবে শারীরিকভাবে কেউ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে বলে তাদের বলে জানা নেই।
“সাগর পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে ধরা পড়ার পর এখানে ১৪ দিন রাখার কথা বলে নিয়ে আসা হয়েছিল আমাদের। কিন্তু চার মাসের বেশি সময় পার হয়েছে। আমরা আর এখানে থাকতে চাই না,” বলেন হালিমা।
চলতি মাসে ভাসানচর সফর করে আসা উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে জামালিদা বেগম বেনারকে বলেন, “ভাসানচরে যারা আছে, তারা যে কোনো উপায়ে কক্সবাজারে ফিরতে চায়।”
অ্যামনেস্টি এবং এইচআরডব্লিউ তাদের ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে। রোহিঙ্গা নারীরা মানবপাচার, যৌন হয়রানি ও বৈষম্যের কথাও বলেছেন বলে অ্যামনেস্টির বিবৃতিতে বলা হয়।
“কক্সবাজারের শরণার্থীদের অধিকাংশই নারী ও শিশু এবং তারা নানা রকম হয়রানি ও বৈষম্যের মুখে আছে। কর্তৃপক্ষ ও সহায়তাদানকারী সংস্থাগুলোর উচিত সব ধরনের পাচার, যৌন নির্যাতন ও বৈষম্যের অভিযোগের তদন্ত করা,” বলেন ডেভিড।
কক্সবাজার থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আবদুর রহমান।