পরিস্থিতি দেখতে রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি পাঠানোর প্রস্তাব দিলো চীন
2019.09.16
কক্সবাজার

দুই দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হওয়ার পর মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে কি না তা দেখতে রোহিঙ্গা নেতাদের রাখাইন পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে মিয়ানমারের বন্ধু রাষ্ট্র চীন।
টেকনাফের শরণার্থী শিবির পরিদর্শনকালে সোমবার রোহিঙ্গাদের সাথে এক বৈঠকে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এই প্রস্তাব দেন বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশি কর্মকর্তারা।
এদিকে রাখাইনে এখনো বসবাস করা ৬ লাখ রোহিঙ্গা গণহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে মন্তব্য করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল।
সোমবার বার্তাসংস্থা এএফপি জানায়, এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সেনা নির্যাতনে বাংলাদেশ পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ‘অসম্ভব’ বলে মন্তব্য করেছেন সংস্থাটির তদন্ত দলের (ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন) সদস্যরা।
মিয়ানমারের পরিস্থিতির ওপর তৈরি করা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন এর প্রতিবেদনটি আগামী কাল মঙ্গলবার জেনেভায় উপস্থাপন করার কথা রয়েছে।
রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি পাঠানোর প্রস্তাব
রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এর নেতৃত্বে চীনের আট সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল রোববার ও সোমবার কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। পাশাপাশি, তাঁরা টেকনাফ শালাবাগান শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের সাথে বৈঠকে বসেন। এ সময় রোহিঙ্গারা তাঁদের দাবিগুলো তুলে ধরেন
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (অতিরিক্ত) শামসুদ্দৌজা নয়ন বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল গঠন করে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পাঠাতে চেয়েছেন চীনের প্রতিনিধি দল। রোহিঙ্গা নেতারা এ বিষয়ে সম্মতি জানিয়েছেন।”
তিনি জানান, চীনের প্রস্তাবে বলা হয়, রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দল মিয়ানমারে গিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি দেখে বাংলাদেশে ফিরে আসবেন। যদি সেখানের অবস্থা ভালো দেখে আসেন, তাহলে পরে পরিবার নিয়ে মিয়ানমারে ফেরত যাবেন।
“তবে এটি চূড়ান্ত কোনো সিদ্বান্ত নয়,” জানিয়ে শামসুদ্দৌজা নয়ন বেনারকে বলেন, “আমরা চীনা রাষ্টদূতকে বলেছি, এ প্রস্তাবের বিষয়টি নিয়ে চীন এবং মিয়ানমারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করার জন্য।”
তিনি বলেন, “আমরা তাঁদের এ প্রস্তাবও দিয়েছি যে, মিয়ানমার ভিজিটে যাওয়ার সময় রোহিঙ্গা দলের সঙ্গে বাংলাদেশ এবং আন্তজার্তিক পর্যায়ের পৃথক দুটি প্রতিনিধি দল থাকবে।”
চীনা রাষ্ট্রদূতের সাথে বৈঠকে উপস্থিত রোহিঙ্গা নেতা মো. জসিম বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ সরকারের সহাতায় মিয়ানমারের পরিস্থিতি দেখতে রোহিঙ্গাদের একটি দল সেদেশে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছেন চীনের রাষ্ট্রদূত। এ বিষয়ে বৈঠকে উপস্থিত রোহিঙ্গারা সম্মতি জানান।”
এদিকে “রাখাইনে রোহিঙ্গা দল পাঠানোর পদক্ষেপ ইতিবাচক ব্যাপার,” মন্তব্য করে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, “যদিও বিষয়টা নির্ভর করবে মিয়ানমারের রাজি থাকার ওপর।”
তবে চীন মিয়ানমারের সাথে আলোচনা করে এমন প্রস্তাব দিয়েছে কি না সে বিষয়ে ঢাকার চীনা দূতাবাসের কাছে মন্তব্য চাওয়া হলে তাঁদের কাছ থেকে কোনো উত্তর মেলেনি।
এর আগে গত ৩০ আগস্ট ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি পাঠানোর প্রস্তাব করেছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন।
রোহিঙ্গাদের তিন দাবি
রোহিঙ্গারা চীনা রাষ্ট্রদূতের প্রস্তাবে সম্মতি জানালেও নাগরিকত্ব এবং তাঁদের ভিটেমাটি ফিরে পাওয়ার দাবিতে অনড় রয়েছেন।
তিন দিনের সফরে গত রোববার কক্সবাজার আসেন চীনা প্রতিনিধি দল।
সফরের প্রথম দিন তাঁরা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ধুমধুম সীমান্তের শূন্য রেখার আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করে রোহিঙ্গাদের সাথে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কথা বলেন।
সফরের দ্বিতীয় দিন সোমবার সকালে চীনা প্রতিনিধিদলটি টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরে যান।
গত আগস্ট মাসে মিয়ানমার প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশে ১ হাজার ৩৩ পরিবারে ৩ হাজার ৫৪০ জনের নামের যে তালিকা পাঠিয়েছিল, তার মধ্যে ৯৩৩ পরিবারে ৩ হাজার ৯১ জন বাস করছেন শালবাগান শিবিরে।
কিন্তু শর্ত ছাড়া ফিরতে রাজি না হওয়ায় গত ২২ আগস্টের দ্বিতীয় দফায় প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয়। শালবাগান শিবিরে বর্তমানে ৪২ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছেন।
বৈঠকে উপস্থিত রোহিঙ্গারা জানান, চীনের প্রতিনিধি দল তাঁদের কাছে জানতে চান, কেন তাঁরা মিয়ানমারে ফিরতে রাজি হচ্ছেন না।
টেকনাফ শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা আবুল ফয়েজ বেনারকে বলেন, “তাঁদের এমন প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলেছি, মিয়ানমারের পরিস্থিতি এখনো শান্ত হয়নি। এখনো যেসব রোহিঙ্গা সেদেশে রয়েছে তাদের ওপর নির্যাতন চলছে।”
তিনি বলেন, “তা ছাড়া গত ২০১২ সালে আকিয়াবে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে কয়েক মাসের জন্য একটি জায়গায় জড়ো করে রাখলেও এখনো পর্যন্ত একই অবস্থায় রয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে মিয়ানমার যাব?”
মোহাম্মদ গুরা মিয়া বেনারকে বলেন, “চীনের প্রতিনিধিদের বলেছি, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, কেড়ে নেওয়া জমি ফেরত ও আন্তর্জাতিকভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ- আমাদের এই তিনটি দাবি পূরণ করলে কালই স্ব-ইচ্ছায় নিজ দেশে (মিয়ানমার) চলে যাব।”
ঘুমধুম কোণারপাড়া নো মেনস-ল্যান্ড শরণার্থী নেতা দিল মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “চীনা প্রতিনিধিরা আমাদের কাছে মিয়ানমারে ফিরতে বাধা সম্পর্কে জানতে চান।”
তিনি বলেন, “আমরা বলেছি, আমাদের নাগরিকত্ব, নিজেদের ভিটেমাটি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা আইডিপি ক্যাম্পে যাব না। সরাসরি নিজেদের বাড়ি-ভিটায় ফিরে যেতে চাই।”
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের সেনা অভিযানের মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢল বাংলাদেশে আসা শুরু হয়। বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি দলের পরিদর্শন
রোববার কক্সবাজারের উখিয়ায় শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধি দল। এ সময় ২০জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা।
কুতুপালং ১৮ নম্বর শিবিরের ক্যাম্প ইনচার্জ (সিআইসি) মো. জাহিদ আখতার বেনারকে বলেন, “মার্কিন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ক্যাম্পে বসেই রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে আসা রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে কীভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন সেসব কাহিনি শোনান।”
এদিকে এই সফরে রাষ্ট্রদূত মিলার রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং তাঁদের আশ্রয় দেওয়া স্থানীয় মানুষদের সহায়তা দিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তহবিল গ্রহীতা সংস্থার প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করেন বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে ঢাকা থেকে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি।