শরণার্থী শিবির থেকে বের হতে মানা রোহিঙ্গাদের
2017.09.18
ঢাকা

রোহিঙ্গাদের স্বার্থে তাঁদের শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করার নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশের পুলিশ। কোনো শরণার্থীকে ক্যাম্পের বাইরে দেখা গেলে দ্রুত পুলিশ প্রশাসনকে জানানোর অনুরোধও করেছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক।
গতকাল সোমবার পুলিশ সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিষয়ে অবহিত করেন আইজিপি। ওই সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদসহ, বাহিনীর বিভিন্ন শাখার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
“রোহিঙ্গাদের স্বার্থে তাঁদের ক্যাম্পের ভেতরে থাকার অনুরোধ করেছি আমরা। তাঁদের ডেটাবেইস তৈরি হচ্ছে। এই ডেটাবেইসের ভিত্তিতে তাঁরা ত্রাণ-সামগ্রী ও পরবর্তীতে সুযোগ-সুবিধা পাবেন, সে কারণেই এই অনুরোধ করা হয়েছে,” বলেন আইজিপি।
তিনি আরও বলেন, “ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়লে ‘রিফিউজি ম্যানেজমেন্টে’ সমস্যা হতে পারে। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দুশ’রও বেশি রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে।”
এর আগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এক নির্দেশনায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শিবির থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়। তা ছাড়া বাংলাদেশি কোনো নাগরিককে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পরিবহন করতে নিষেধ করা হয়।
ত্রাণের আড়ালে জঙ্গিবাদ বরদাশত নয়
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের দায়ে কারারুদ্ধ জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ছেলেকে প্রচারপত্রের মতো কিছু একটা বিলি করতে দেখা যায় একটি ছবিতে।
এ বিষয়ে আইজিপির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, “সরকার আগেই জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের নির্দেশ দিয়েছে। এর বাইরে কেউ স্ব উদ্যোগে বা কোনো প্রতিষ্ঠান ত্রাণ দিতে পারবে না। ত্রাণের আড়ালে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা সেটা প্রতিহত করার চেষ্টা করছি।”
তিনি আরও বলেন, “সরকারের অবস্থান হলো বাংলাদেশের ভূমি কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। সেটি নিশ্চিত করতে আমরা বদ্ধপরিকর।”
এ দিকে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে যেন কেউ বেরিয়ে না পড়েন তা নিশ্চিত করতে জেলায় ১১টি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। বাসে যাঁরা চলাচল করছেন তাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্রও দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন জানান, তাঁরা কঠোরভাবে নজরদারি করছেন।
“আমরা কক্সবাজারের ১১টা পয়েন্টে নজরদারি করছি। আজকেই ক্যাম্প ছেড়ে পালানোর সময় ৩শ রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করে বালুখালি ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়েছি আমরা,” ইকবাল হোসেন বলেন।
তবে রোহিঙ্গাদের অন্যভাবে বিষয়টি বোঝাতে হবে বলে মনে করেন শরণার্থী ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর।
আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বোঝাতে হবে। তাদের সম্প্রদায়ের লোকজনকে দায়িত্ব দেওয়া যায়, তারা যেন বুঝিয়ে বলে ক্যাম্পের বাইরে গেলে কী কী অসুবিধা হতে পারে।”
“ক্যাম্প থেক বের হলেই আটক করার এই প্রক্রিয়া বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে। ব্যাপক প্রচার, পাশাপাশি নজরদারি চলতে পারে,” বলেন তিনি।
বুনো হাতির আক্রমণে দুই রোহিঙ্গার মৃত্যু
রোববার দিবাগত রাতে উখিয়ার কুতুপালং নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় বন্য হাতির আক্রমণে শিশুসহ দুজন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।
কুতুপালং মধুরছড়া গুলশান পাহাড়ের ওই মর্মান্তিক ঘটনায় আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা নারীও আহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন উখিয়া থানার পরিদর্শক এম কাই কিসলু। তারা কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
তিনি জানান, নিহতরা হলেন; শামসুল আলম (৫৫) ও তাঁর দু’বছর বয়সী ছেলে শহীদুল আলম। শামসুল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বলিবাজার ফকিরের ডেইল এলাকা বাসিন্দা। তারা সম্প্রতি বাংলাদেশে পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নেন।
স্থানীয়রা জানান, কুতুপালংয়ের মধুরছড়া গুলশান পাহাড় দুর্গম এলাকা এবং হাতির নিয়মিত বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। তবে নতুন রোহিঙ্গারা এসব পাহাড়েও বসবাস শুরু করায় বন্য হাতি চলাচল ব্যহত হচ্ছে।
কক্সবাজার বন কর্মকর্তা (দক্ষিণ) আলী কবির বেনারকে বলেন, “ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের একটি নির্দিষ্ট স্থানে নেওয়ার কাজ চলছে।”
প্রতিকূল আবহাওয়া নতুন দুর্ভোগ
সর্বস্ব ছেড়ে জীবন ভয়ে পালিয়ে এসে কোনো রকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য নতুন দুর্ভোগ হয়ে এসেছে প্রতিকূল আবহাওয়া। কদিন ধরেই কক্সবাজারে অল্পস্বল্প বৃষ্টি হলেও রোববার উখিয়া এলাকায় ভারী বৃষ্টিতে সাময়িক আশ্রয়ও হারাতে হয়েছে বহু রোহিঙ্গাকে।
পাহাড়ের ঢালে তৈরি বস্তিগুলো ডুবে যাওয়ায় শত শত রোহিঙ্গাকে রাস্তার দুপাশে আশ্রয় নিতে দেখা যায়। বৃষ্টির ফলে কমে আসে ত্রাণ সহায়তাও। ফলে দুর্ভোগে পড়তে হয় তাদের।
জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সূত্র অনুসারে, গত ২৫ আগস্টের পর থেকে সোমবার পর্যন্ত চার লাখ ১৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। উখিয়ার কুতুপালং এবং টেকনাফের লেদা ও নয়াপাড়ার পুরোনো ক্যাম্পের পাশাপাশি দুই উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে এসব রোহিঙ্গারা।
এছাড়া মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার পথে ২৫ আগস্ট থেকে সোমবার পর্যন্ত অন্তত ১১০ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। এসব মৃত্যুর বেশিরভাগই নাফ নদীতে নৌকাডুবির কারণে ঘটেছে বলে জানা যায়।
নতুন গড়ে ওঠা বস্তিতে ঘরের অবকাঠামো বলতে কোনো রকমে মাটি সমতল করে বাঁশের খুঁটি পুঁতে ত্রিপল বা প্লাস্টিকের ছাউনি দেওয়া ঘর। মাটিতেও একইভাবে ত্রিপল বা পলিথিন বিছানো। এসব ছাউনি একটু ভারী বৃষ্টিতেই নুয়ে পড়ে, তলিয়ে যায় ঘরের মেঝে।
বৃষ্টির কারণে নানা ধরনের অসুস্থতা দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গা শিবিরে। বৃষ্টিতে ভিজে কিংবা ভেজা মাটিতে শুয়ে শিশু ও বয়স্কদের অনেকেই সর্দি-জ্বরে রোগে আক্রান্ত হয়েছে। মেডিকেল ক্যাম্পগুলোতে সোমবার রোগীদের ভিড় বেশি দেখা যায়।
উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মিজবাহ উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “আমাদের সাধ্যমতো রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হচ্ছে।”
এ ছাড়া বেসরকারিভাবেও বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য সেবা দিতে দেখা যায়।
এদিকে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন বেনারকে বলে, নতুন রোহিঙ্গাদের জন্য সেনাবাহিনী চার হাজার শেড নির্মাণ করবে। প্রতিটি শেডে ৮০ টি পরিবার বসবাস করতে পারবে বলে আশা করি।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি