রোহিঙ্গা শিবিরে ইন্টারনেট সেবা বন্ধে বিপাকে স্থানীয়রা

সুনীল বড়ুয়া ও কামরান রেজা চৌধুরী
2019.09.18
কক্সবাজার ও ঢাকা
190918_Internet_Service_1000.jpg হিন্দু রোহিঙ্গা সরস্বতী দেবী উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবির থেকে মোবাইলের মাধ্যমে ভিডিও কলে মিয়ানমারে থেকে যাওয়া তাঁর মায়ের সাথে কথা বলছেন। রোহিঙ্গারা বলছেন, শরণার্থী শিবির এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবার কারণে তাঁরা মিয়ানমারে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
[এপি]

রোহিঙ্গাদের ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে বিরত রাখতে উখিয়া ও টেকনাফে বিকেল থেকে সকাল পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হওয়ায় স্থানীয় কয়েক হাজার বৈধ মোবাইল ব্যবহারকারী বিপদে পড়েছেন।

তাঁরা দিনে ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছেন না, আবার ভয়েস কলও ঠিকমতো হচ্ছে না। এতে সরকারি দপ্তরগুলোর কাজও ব্যাহত হচ্ছে।

স্থানীয়দের সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন।

তবে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন চেয়ারম্যান জহুরুল হক বেনারকে বলেছেন, উখিয়া ও টেকনাফে ইন্টারনেট সেবা পুনরায় চালুর কোনো পরিকল্পনা আপাতত নেই। তিনি বলেন, বৃহত্তর স্বার্থে উখিয়া ও টেকনাফের মানুষের সমস্যা হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা রতন দে বেনারকে বলেন, “শুধু থ্রিজি ফোরজি নয়, টুজি নেটওয়ার্কে মোবাইলে কথা বলার সময়ও ঘন ঘন কল ড্রপ হচ্ছে। কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। নানা বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে স্থানীয়দের।”

পালংখালী ইউপির চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে উখিয়া-টেকনাফ উপজেলায় সব ধরনের মোবাইল সিমসহ নতুন সংযোগ প্রদানও বন্ধ রয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের অনেকেই মোবাইল ব্যবহার করছে। মোবাইল সেবা নিয়ে স্থানীয়দের চেয়ে এগিয়ে আছে রোহিঙ্গারা।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “মোবাইল অপারেটরগুলো কেন্দ্রীয়ভাবেই নেটওয়ার্ক বা ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ন্ত্রণ করে। তাই স্থানীয় জনগোষ্ঠীও থ্রিজি ফোরজি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “আমি নিজেও সমস্যায় আছি। অফিসে ব্রডব্যান্ডের সংযোগ থাকলেও বাইরে গেলে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। মানুষ এখন মোবাইল নির্ভর হয়ে গেছে। মোবাইলেই গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ করা যায়। সেই কাজগুলো হচ্ছে না।

তিনি বলেন, “এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে থ্রিজি ফোরজি সেবা কীভাবে চালু রাখা যায়, তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা চলছে।”

তবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বেনারকে বলেন, “দেখুন আমরা জাতীয় নিরাপত্তার কারণে উখিয়া ও টেকনাফে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করেছি। ভালো কিছু করতে গেলে কাউকে না কাউকে কিছু ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়ে। এ কারণে, উখিয়া ও টেকনাফের মানুষ যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যা বোধ করছেন।”

তিনি বলেন, “আমরা বিষয়টি জানি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই দুই অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা চালু করা অথবা মোবাইল সিগন্যাল শক্তিশালী করার কোনো পরিকল্পনা নেই।”

বাংলাদেশ মোবাইল টেলিযোগাযোগ কোম্পানিগুলোর সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল কবির বেনারকে বলেন, “প্রথম কথা হলো, মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা সমাধান নয়। উখিয়া, টেকনাফে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করাটা আসলে মাথা কেটে ফেলার মতো।”

নুরুল কবির বলেন, “সরকারি নিয়ম যদি হয়, রোহিঙ্গারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবে না, তাহলে সেই নিয়ম মানতে হবে। এই নিয়ম বাস্তবায়নের উপায় আছে।”

তিনি বলেন, “জাতীয় পরিচয়পত্র না দিলে মোবাইল সিমকার্ড পাওয়া যায় না। রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার উপায় বন্ধ করলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আমার মনে হয় সরকারের সেদিকে মনোযোগ দেয়া উচিত। ইন্টারনেট ও মোবাইল সেবা বন্ধ করা কোনো সমাধান নয়।”

প্রসঙ্গত, কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গাদের প্রযুক্তি নির্ভর নানা অপরাধ ঠেকাতে গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে রোহিঙ্গা শিবির ও আশেপাশের এলাকায় প্রতিদিন বিকেল পাঁচটা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত ফোর-জি এবং থ্রি-জি মোবাইল সেবা বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন। এর ফলে ওই সময় ওই এলাকায় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রয়েছে।

তবে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেবার কারণে এখনো আরাকানে থেকে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করে সেখানকার প্রকৃত অবস্থা জানতে পারছেন না বলে বেনারকে জানিয়েছেন রোহিঙ্গারা।

মিয়ানমারের ২০টি সিমসহ ৩ রোহিঙ্গা আটক

উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মোবাইলের থ্রিজি–ফোরজি সেবা বন্ধ করে দেওয়ার পর রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের মোবাইল অপারেটরের সিম ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ মিলেছে।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় টেকনাফে মিয়ানমারের ‘এমপিটি’ নামের একটি মোবাইল ফোন অপারেটরের ২১০ টি সিম কার্ডসহ তিনজন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ।

টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বেনারকে জানান, মিয়ানমারের মোবাইল ফোন কোম্পানির বেশ কিছু সিম রোহিঙ্গাদের কাছে বিক্রির জন্য বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে একটি চক্র। গোপন সূত্রে এমন খবর পেয়ে সন্ধ্যায় টেকনাফ স্থল বন্দরে অভিযান চালানো হলে ২১০টি সিমসহ তাঁদের আটক করা হয়।

কক্সবাজার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসেন বেনারকে জানান, রোহিঙ্গাদের মোবাইল ব্যবহারের প্রবণতা কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা চলছে।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে যৌথ টহল জোরদারসহ আগের চেয়ে নজরদারি অনেক বাড়ানো হয়েছে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বেনারকে বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন রোহিঙ্গা শিবিরে থ্রিজি-ফোরজি সেবা নিয়ন্ত্রণ করেছে। তবে এটা যদি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ভোগান্তির কারণ হয়ে যায় সে বিষয়টিও অবশ্যই সরকার বিবেচনা করবে।

এদিকে প্রযুক্তিগতভাবে মিয়ানমারের মোবাইল কোম্পানিগুলোর সিগন্যাল বাংলাদেশে বন্ধ করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন নুরুল কবির।

তিনি বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের মোবাইল কোম্পানির সিগন্যাল বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় আসতে পারে। সেক্ষেত্রে মিয়ানমারের সিমকার্ড বাংলাদেশে কাজ করতে পারে।”

“তবে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন মিয়ানমারের কোম্পানিগুলোর সিগন্যাল কাজ করা বন্ধ করতে পারে। প্রযুক্তিগতভাবে সেটি সম্ভব। মিয়ানমারের মোবাইল বাংলাদেশে কাজ করছে মানে রেগুলেটররা ঠিকমত কাজ করছেন না,” বলেন নুরুল কবির।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।