নীরবতা ভাঙলেন সু চি, বক্তব্য দিয়ে ফের সমালোচিত

প্রাপ্তি রহমান ও কামরান রেজা চৌধুরী
2017.09.19
ঢাকা
মিয়ানমারের রাজধানী নাইপিদোতে জাতিসংঘ প্রতিনিধি ও বিভিন্ন দেশের কূটিনীতিকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি। রাখাইন রাজ্যের সংকট নিয়ে মিয়ানমারের রাজধানী নাইপিদোতে জাতিসংঘ প্রতিনিধি ও বিভিন্ন দেশের কূটিনীতিকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
RFA

গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সবশেষ সহিংসতা শুরু হওয়ার পর রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে প্রথম মুখ খুললেন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেত্রী অং সান সু চি। তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে নীরব থাকায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ওই নেত্রী।

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সু চি বলেন, রাখাইন থেকে মুসলমানদের পালিয়ে বাংলাদেশে যাওয়ার খবরে তারা (সরকার) উদ্বিগ্ন। রাখাইনে চলমান সহিংসতার মুখে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার প্রেক্ষাপটে তাঁর এই বক্তব্য নতুন সমালোচনা সৃষ্টি করেছে।

প্রায় ৩০ মিনিটের ভাষণে সু চি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ‘বিভ্রান্ত করার’ চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি​সহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, বাংলাদেশ, ভারত ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সু চির বক্তব্যের কড়া সমালোচনা হচ্ছে।

মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গতকালই এক বিবৃতিতে বলেছে, “ভাষণে সু চি স্পষ্ট করেছেন যে, তিনি ও তাঁর সরকার রাখাইনের সহিংসতা বিষয়ে বালুতে মাথা গুঁজে রেখেছেন। তিনি বরং তাঁর বক্তব্যে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। যারা আক্রান্ত হয়েছে, তাদেরই উল্টো তিনি দোষারোপ করেছেন।”

“আমি এই বক্তব্যে নতুন কিছু দেখতে পাইনি। তাঁর বক্তব্যে এক ধরনের অসহায়ত্ব এবং অপারগতা প্রকাশ পেয়েছে,” বেনারকে বলেন ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ।

সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তা বলেন, সু চি সেনাবাহিনীর ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে চাননি। অথচ সেনারাই হচ্ছে দেশটির মানবাধিকার লঙ্ঘনের মূল হোতা। তিনি সেনাবাহিনীর সুরে কথা বলেছেন।

এদিকে বার্তা সংস্থা এএফপি গতকাল জানায়, অং সান সু চি তার বক্তব্যে আন্তর্জাতিক নিন্দা প্রশমনে ব্যর্থ হন। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সামরিক অভিযান বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সূচনা বক্তব্যে মহাসচিব বলেন, “মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই সামরিক অভিযান বন্ধ করতে হবে। অবাধে মানবিক সাহায্য পাঠানোর অনুমতি দিতে হবে।”

কুয়ালালামপুর ভিত্তিক রোহিঙ্গা সাংবাদিক সেলিম মজিদ বেনারকে বলেন, “সেখানে ৭৭টি গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, বাড়িঘর ছাই হয়ে গেছে। মানুষ তাদের বৃদ্ধ পিতা-মাতাদের ঘাড়ে বহন করে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে হাঁটছে। কেউবা সীমান্তে যাবার পথে মারা যাচ্ছে।” তাঁর প্রশ্ন—“অং সান সুচি কি অন্ধ?”

গতকাল সু চি বক্তৃতা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৩৬তম অধিবেশনে মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধান মিশনের প্রধান মারজুকি দারুসমান বলেন, রাখাইনে যেসব সহিংসতার অভিযোগ পাওয়া গেছে, তা খতিয়ে দেখতে প্রয়োজন দেশটিতে অবাধে প্রবেশের নিশ্চয়তা।

অং সান সু চি তাঁর ভাষণে বলেন, রাখাইন সহিংসতায় সব মানুষের দুর্ভোগ গভীরভাবে অনুভব করেন তিনি। রাখাইন থেকে মুসলিমরা কেন পালিয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছে, তা খুঁজে বের করতে চান বলে ভাষণে উল্লেখ করেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ওই নেত্রী।

“তারা (মিয়ানমার) বৈশ্বিক নেতৃত্বকে অগ্রাহ্য করছে, বৈশ্বিক নেতৃত্বকে থুথু দিচ্ছে। তারা বলছে আমরা তোয়াক্কা করি না। আমরা রোহিঙ্গাদের হত্যা করেই যাব। আসলে তিনি নোবেল শান্তি বিজয়ী হিসেবে ব্যর্থ হয়েছেন,” বেনারকে বলেন কুয়ালালামপুর ভিত্তিক রোহিঙ্গা টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুর ইসলাম।

নূর ইসলাম বলেন, “আমি ২০১২ সাল থেকে বলে আসছি যে সু চির জন্য এটি একটি পরীক্ষা। যদি এটিকে সঠিকভাবে পরিচালনা না করা হয় তাহলে তিনি এই পুরষ্কারের যোগ্য থাকবেন না। এখন তিনি আর নোবেল বিজয়ী নন; তিনি একজন খুনী।”

এদিকে পরিস্থিতি দেখার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রাখাইন পরিদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন সু চি। এ ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতারও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে বলেছেন, কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে তাঁর সরকার কাজ করবে।

“আমরা শান্তি চাই, ঐক্য চাই। যুদ্ধ চাই না,”—এই বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি সু চি সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বেআইনি সহিংসতার নিন্দা জানান।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রাখাইন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের বিষয়ে মিয়ানমার সরকার ভীত নয় বলে উল্লেখ করেন সু চি। তিনি বলেন, তাঁরা অনেক সমস্যা মোকাবিলা করছেন। সব সমস্যাই মোকাবিলা করতে হবে। কিছু সমস্যা নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না।

রাখাইন সংকট প্রসঙ্গে সু চি বলেন, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ আছে। তাদের সব কথাই শুনতে হবে। কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগে অভিযোগগুলো যে তথ্য-প্রমাণনির্ভর, তা নিশ্চিত করতে হবে।

ভারতীয় বিশ্লেষকেরা অং সান সুচির এই বক্তব্যকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। তাঁরা বলছেন, সুচির বক্তব্য থেকে প্রথমবারের মত মনে হচ্ছে যে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার সরকার নিজেকে উন্মুক্ত করছে।

“যদিও তার ভাষণটি কূটনৈতিক প্রকৃতির, তবু মনে হচ্ছে রোহিঙ্গারা কেন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যাচ্ছে সেই কারণ বের করতে চাইছেন,” বেনারকে বলেন নয়াদিল্লি ভিত্তিক পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের বিশ্লেষক বিনয় কওরা।

নয়াদিল্লি ভিত্তিক বিশ্লেষক দুষইয়ান্ত নাগর বেনারকে বলেন, “বর্তমান সংকট বিবেচনা করে যদি তিনি শরণার্থীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে চান তবে তা প্রকৃত অর্থেই ইতিবাচক পদক্ষেপ।” তবে তাঁর মতে, রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জন করতে হবে।

সু চির এই বক্তব্য প্রসঙ্গে বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে অ্যামনেস্টি, এইচআরডব্লিউসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবেদনে সেখানে নির্যাতনের চিত্র পরিস্কার। এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই বলে জানান তিনি।

“তাঁর এই বক্তব্যে হতাশ কিংবা আশ্চর্য হইনি। সামরিক বাহিনীর নীতিকেই তিনি অনুসরণ করছেন,” জানান নূর খান।

এদিকে কুয়ালালামপুর ভিত্তিক সাংবাদিক মোহাম্মদ নুর ইসলাম বলেন, “এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা যে অং সান সুচির প্রশাসন পরবর্তী সময়ে কিছু করবে। রোহিঙ্গারা বিলুপ্তির পথে, তারা মারা যাচ্ছে। তিনি এখন কী বলবেন? তার পুরানো ভাবমূর্তি আর কাজ করবে না।”

তিনি আরও বলেন, সু চি এই গণহত্যার অংশ; এখানে তার সায় আছে। এটা বন্ধ করাটা তার হাতে, তবে তিনি তা করবেন না। তিনি এই সকল মানুষদের হত্যার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এবং রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে দোষারোপ করছেন। আজকের এই কাজ তাদের ৭০ থেকে ৮০ বছর কর্মকাণ্ডের ফলাফল।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন মালয়েশিয়া থেকে হাদি আজমি ও নয়াদিল্লি থেকে আকাশ বশিষ্ঠ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।