রোহিঙ্গা শিবিরে ফের খুন, ‘নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ করছে সশস্ত্র গ্রুপগুলো’
2022.09.21
কক্সবাজাৱ ও ঢাকা
কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে একের পর এক হামলা ও খুন চালিয়ে বিদ্রোহী রোহিঙ্গা গ্রুপগুলো সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে। এর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে রাতে পাহারার পদ্ধতি অকার্যকর করার চেষ্টা করছে বলে মনে করছেন পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবীরা।
সর্বশেষ মঙ্গলবার ভোররাতে একজন স্বেচ্ছাসেবীকে হত্যা করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।
“আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবীদের পাহারার ফলে ক্যাম্পে আগের তুলনায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করা আগের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে এসব গ্রুপ এখন নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ করা বা ব্যবস্থাটিকে অকার্যকর করার চেষ্টা করছে,” বেনারকে বলেন এপিবিএন-এর সহকারী পুলিশ সুপার (অপারেশন) মো.ফারুক আহমেদ।
তিনি বলেন, শিবিরগুলোর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রশ্নবিদ্ধ করতে এসব ক্যাম্পভিত্তিক সন্ত্রাসী দলগুলো নিরাপত্তাকর্মীদের টার্গেট হিসেবে বেছে নিয়েছে। এরা প্রতিনিয়ত অবস্থান ও কৌশল বদল করে কার্যক্রম চালায়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত অক্টোবর থেকে চালু হওয়া স্বেচ্ছা পাহারার সাথে জড়িত রোহিঙ্গা নেতা ও স্বেচ্ছাসেবীদের অনেকেই এসব সন্ত্রাসীর হামলায় নিহত ও আহত হয়েছেন।
মঙ্গলবার ভোররাতে উখিয়ার বালুখালী ১৮ নম্বর শিবিরে স্বেচ্ছাসেবী পাহারায় থাকা মো. জাফর (৩৫) নিহতের পর রোহিঙ্গা শিবিরে আতঙ্কে ছড়িয়ে পড়ে।
“দুষ্কৃতকারীদের একটি দল ক্যাম্প-১৮ এর এইচ/৫১ ব্লকে প্রবেশ করে পাহারারত স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর আক্রমণ করে এবং ১/২ রাউন্ড গুলি করে। পরে তারা ভলান্টিয়ার জাফরকে কুপিয়ে হত্যা করে,” জানান এপিবিএন কর্মকর্তা মো. ফারুক।
ওই হত্যার সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলার পাশাপাশি শিবিরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আরসা জড়িত থাকার অভিযোগ
সন্ত্রাসীদের মঙ্গলবারের ওই হামলায় জাফরের সাথে থাকা আরো কয়েকজন আহত হন বলে বেনারকে জানান স্বেচ্ছাসেবক রোহিঙ্গা নেতা মো. হারুন।
তিনি বলেন, “আমাদের ধারণা এই হামলার সাথে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্যরা জড়িত।”
এ ঘটনার পর থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা ভয়ের মধ্য রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁর ক্যাম্পে প্রায় ৪০০ স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে, যাদের তৎপরতায় ক্যাম্পভিত্তিক সন্ত্রাসীরা বাঁধার মুখে পড়ছে। ফলে সন্ত্রাসীরা স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে।
এর আগে গত জুন মাসে হারুনের ক্যাম্পের একজন স্বেচ্ছাসেবক মাঝিকে (নেতা) গুলি করে হত্যা করা হয় বলে জানান তিনি।
রোহিঙ্গা নেতারা জানান, রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন আরসা ক্যাম্পটিতে আস্তানা গড়তে চায়। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা পেয়ে গত বছর ক্যাম্পের এইচ-৫২ ব্লকের একটি মাদরাসায় রাতের অন্ধকারে হামলা চালিয়ে ৬ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করে।
প্রায় তিন মাসে ১১ খুন
গত জুলাই থেকে গত প্রায় তিন মাসে রোহিঙ্গা শিবিরে তিন মাঝিসহ অন্তত ১১ জন খুন হয়েছেন। এদের মধ্য পাঁচজন ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক। এর আগে গত ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মো. ইব্রাহীম (৩০) নামে এক রোহিঙ্গা নিহত হন।
এ ছাড়াও ১০ জুন কুতুপালং ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ সমিন (৩০) এবং ৯ জুন রোহিঙ্গা নেতা আজিম উদ্দিনকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
গত মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬) নামে দুই স্বেচ্ছাসেবক।
গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ এবং ২২ অক্টোবর ১৮ নম্বর ক্যাম্পের একটি মাদ্রাসার ছয় ছাত্র-শিক্ষককে হত্যার পর ক্যাম্পে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে গত বছরের অক্টোবর থেকে ক্যাম্পে চালু হয় ব্লকভিত্তিক স্বেচ্ছাপাহারা।
বর্তমানে ৮-এপিবিএন এর আওতাধীন ক্যাম্পগুলোতে প্রতি রাতে প্রায় চার হাজার স্বেচ্ছাসেবী রোহিঙ্গা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এছাড়া ১৪-এপিবিএনের অধীনে তিন হাজার ৫১৬ জন এবং ১৬-এপিবিএনের অধীনে তিন হাজার সাতশ স্বেচ্ছাসেবক একই কাজ করছেন।
শিবিরের বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের শুধু পুলিশ দিয়ে নিরাপত্তা দেয়া কঠিন জানিয়ে ফারুক বলেন, “এ কারণে ব্লক অনুযায়ী স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে পাহারা চালু করা হয়েছে। এটি কোনোভাবে ভেঙে যেতে দেওয়া হবে না।”
“আমরা ব্লক-রেইড অভিযান অব্যাহত রেখেছি। কোনো অপরাধী পার পাওয়ার সুযোগ নেই,” বলেন তিনি।
মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে আটক ২২
সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রস্তুতিকালে কক্সবাজারের টেকনাফে অভিযান চালিয়ে সাত রোহিঙ্গাসহ ২২ জনকে উদ্ধার করেছেন বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা।
মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে টেকনাফ পৌরসভার বাসস্ট্যান্ডের পেছনে জামাল উদ্দিনের বাড়ি থেকে উদ্ধার ২২ জনকে থানায় হস্তান্তর করা হয়।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি হাফিজুর রহমান জানান, সাত রোহিঙ্গাসহ ২২ বাংলাদেশিকে মানব পাচারকারী দালাল চক্র সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে- এমন খবরে নাফ নদ-তীরবর্তী পৌরসভার নাইট্যংপাড়ার দালাল জামালের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। এ সময় ২২ জনকে উদ্ধার করা হয়।
জাতিসংঘের বলিষ্ঠ ভূমিকা চান প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোরপূর্বক বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের তাদের জন্মভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে এবং এই সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ও জাতিসংঘকে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনে তাঁর আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন, খবর বাসস।
শরণার্থী বিষয়ক ইউএন হাইকমিশনার ফিলিপো গ্রান্ডি তাঁর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করার সময় প্রধানমন্ত্রী এই আহ্বান জানান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ইউএনজিএ’র ৭৭তম অধিবেশনের সাইডলাইন বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যক্রমের ব্যাপারে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন।
গ্রান্ডির সঙ্গে ওই বৈঠকে শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারে ইউএনএইচসিআরের কার্যক্রম জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এর জবাবে ফিলিপো বলেন, তিনি দ্রুত মিয়ানমার সফর করবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমেই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান সম্ভব।
ইউএনএইচসিআর হাইকমিশনারও এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন।