ফেসবুককে রোহিঙ্গা বিরোধী সব তথ্য ও ভিডিও প্রকাশ করতে যুক্তরাষ্ট্র আদালতের নির্দেশ

কামরান রেজা চৌধুরী ও জন বেকটেল
2021.09.23
ঢাকা ও ওয়াশিংটন ডিসি
ফেসবুককে রোহিঙ্গা বিরোধী সব তথ্য ও ভিডিও প্রকাশ করতে যুক্তরাষ্ট্র আদালতের নির্দেশ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর কিছুদিন পর রাখাইন রাজ্যের একটি অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত শিবিরের বাইরে মিয়ানমার পুলিশের পাহারা। ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
[এএফপি]

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ফেসবুককে রোহিঙ্গা বিরোধী সকল পোস্ট ও ভিডিও প্রকাশ করার আদেশ দিয়েছে সেদেশের ফেডারেল আদালত। এর ফলে রোহিঙ্গা বিরোধী উপাদানগুলো প্রকাশ করতে বাধ্য হবে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।

ওয়াশিংটন ডিসিতে ফেডারেল আদালতের বিচারপতি জিয়া এম ফারুকি বুধবার এই আদেশ দেন। ওই আদেশের একটি কপি বেনারের হাতে রয়েছে।

“ফেসবুক স্বীকার করেছে যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণাবাদী ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ফেসবুক ব্যবহার করেছে,” জানিয়ে বিচারক বলেন, প্রথম ধাপের দায়িত্ব হিসেবে গণহত্যায় ইন্ধন জোগানো ওইসব কনটেন্ট ফেসবুক মুছে ফেলেছে। “এখন পরবর্তী ধাপে তাদেরকে ওই কনটেন্টগুলো প্রকাশ করতে হবে।” 

ফেসবুকের ওই কনটেন্টগুলো রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়ার অভিযোগ তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে জানান বিচারক।

প্রসঙ্গত, গাম্বিয়ার আবেদনের প্রেক্ষিতেই ফেডারেল আদালত এই আদেশ দিলো।

এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলায় গাম্বিয়ার অন্যতম আইনজীবী পল রেচলার এই রায়কে স্বাগত জানয়ে বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “এই রায় আমাদেরকে ফেসবুক থেকে মুছে ফেলা তথ্যগুলো পাওয়ার সুযোগ দেবে।”

রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণ চালানোর সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের ভেতর তথ্য আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে ফেসবুক প্লাটফর্মটি ব্যবহার করা হয়েছিল বলে জানান রেচলার।

রোহিঙ্গা নির্যাতনের ক্ষেত্রে “ফেসবুক ছিল অন্যতম হাতিয়ার,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমি খুবই হতাশ যে ফেসবুক ওই বার্তাগুলো স্বেচ্ছায় দিতে রাজি ছিল না।”

ফেসবুক কবে তথ্যগুলো দেবে তা তিনি এখনো জানেন না জানিয়ে রেচেল বলেন, আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে ফেসবুকের আপিল করার সুযোগ রয়েছে। 

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তায় বাংলাদেশ মর্মাহত—নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন মন্তব্য করার কাছাকাছি সময়ে বৃহস্পতিবার ফেডারেল আদালতের এই আদেশ দেশে–বিদেশে রোহিঙ্গা ইস্যুটি নতুনভাবে সামনে এনেছে। 

এ ছাড়া বুধবারই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য নতুন ১৮ কোটি ডলার সহায়তা ঘোষণা করেছে মার্কিন প্রশাসন। এই নিয়ে ২০১৭ সালের পর থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য দেড় বিলিয়ন বা ১,৫০০ কোটি ডলার সহায়তা ঘোষণা করেছে আমেরিকান সরকার। 

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ব্যাপক সামরিক অভিযানের মাধ্যমে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয়ার সময় এবং পরবর্তীতে ফেসবুকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পোস্ট ও ভুয়া ভিডিও আপলোড করা হলেও ব্যক্তিগত সুরক্ষার কথা উল্লেখ করে সেগুলো প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানায় ফেসবুক।

তবে আদালতের নির্দেশে সেগুলো প্রকাশ করা হলে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠিত হয়েছে কি না তা তদন্ত করতে এবং আন্তর্জাতিক আদালতে চলমান মামলাগুলো প্রমাণ করার পথ প্রশস্ত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ এর সাবেক চেয়ারম্যান মুনশি ফায়েজ আহমাদ বেনারকে বলেন, “মার্কিন বিচারক ফেসবুককে রোহিঙ্গা বিরোধী উপাদানগুলো বের করে দিতে বলেছে—এটি একটি ভালো খবর।”

“মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং উগ্র গোষ্ঠীগুলো রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠনের সময় এবং পরে বিভিন্ন সময়ে প্রচুর রোহিঙ্গা বিরোধী পোস্ট, ভিডিও আমরা দেখেছি,” জানিয়ে তিনি বলেন, ওই উপাদানগুলো প্রকাশ হলে তা “মিয়ানমারের এবং সেদেশের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে নেওয়া গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের অভিযোগগুলো প্রমাণে সহায়তা করবে।” 

আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা দখলের পর সেখান থেকে লাখ লাখ শরণার্থী বিভিন্ন দেশে পালাচ্ছে। এখন আফগান শরণার্থীদের নিয়ে সবাই এতো বেশি শঙ্কিত যে দাতারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে কম মাথা ঘামাচ্ছে বলে জানান মুনশি ফায়েজ। 

এই সময়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ১৮০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা ঘোষণা করল, “সেটি ইতিবাচক,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তবে রোহিঙ্গারা যাতে তাদের দেশ মিয়ানমারে স্বেচ্ছায়, সম্মানজনকভাবে ও নিরাপদে ফিরে যেতে পারে সে ব্যাপারে সহায়তা করা উচিত।”

রোহিঙ্গাদের অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরতে হবে: প্রধানমন্ত্রী

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের বর্ডার পুলিশ সদস্যদের ওপর আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার জবাবে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়া-টেকনাফের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্যে শত শত বছর ধরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর সামরিক অভিযান শুরু করে সে দেশের সেনাবাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধরা। প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সেদেশ থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।

বাংলাদেশ সরকারে হিসেবে, বর্তমানে সব মিলিয়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের উখিয়া ও টেকনাফে ঘিঞ্জি খুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন।

প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর করলেও একজন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়নি মিয়ানমার সরকার। 

চার বছর পার হয়ে গেলেও প্রত্যাবাসন নিয়ে কোনো অগ্রগতি না থাকায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেয়ার আগে নিউইয়র্ক সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার ভোরে বাংলাদেশের হতাশার কথা তুলে ধরেন।

রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসস জানায়, ‘অতি জরুরি’ ভিত্তিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জোরদার করার দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “এ সংকট প্রশ্নে প্রধান আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর নিষ্ক্রিয়তা বাংলাদেশকে মর্মাহত করেছে। অথচ, সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল।"

বুধবার নিউইয়র্কে বাংলাদেশের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘হাই-লেভেল সাইড ইভেন্ট অন ফরসিবলি ডিসপ্লেস মিয়ানমার ন্যাশনালস (রোহিঙ্গা) ক্রাইসিস: ইম্পারেটিভ ফর এ সাস্টেইনাবল সল্যুশন’ শীর্ষক ভার্চুয়াল বৈঠক প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, “আমি বারবার বলেছি, তারা (রোহিঙ্গারা) মিয়ানমারের নাগরিক। সুতরাং, তাদের অবশ্যই নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিয়ে তাদের জন্মভূমি মিয়ানমারেই ফিরে যেতে হবে।”

তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতএব, এ ব্যাপারে জরুরি প্রস্তাব গ্রহণ করা প্রয়োজন এবং আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, এক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশে যা কিছু করছি তা সম্পূর্ণরূপে অস্থায়ী ভিত্তিতে করা হচ্ছে।” 

“রোহিঙ্গাদের তাদের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যা কিছু করা সম্ভব তা অবশ্যই করতে হবে। এদিকে, তারা নিজেরাও তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে চায়,” বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “আমাদের অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে, মানবিক সহায়তা জরুরি হলেও এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়।” 

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “আমি মনে করি প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলেছেন সেটি সঠিক। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারেনি।” 

তিনি বলেন, “২০১৭ এবং ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে তাঁর বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পাঁচ দফা দাবি পেশ করেন, যার মধ্যে অন্যতম ছিল রাখাইনে সেইফ জোন সৃষ্টি করা। সেগুলোর কোনোটিই হয়নি।”

“যদি রোহিঙ্গা ইস্যুকে জিইয়ে রাখা না যায়, তবে এটি আরেকটি আন্তর্জাতিক ঘটনায় চাপা পড়ে যাবে,” বলেন তৌহিদ হোসেন। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা সংকটটি যাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে হারিয়ে না যায় সেজন্য ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা বজায় রেখেছে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশ কোনোভাবেই রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে গ্রহণ করবে না।”

রোহিঙ্গাদের অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরে যেতে হবে জানিয়ে ফারুক খান বলেন, “সে কারণেই আমরা মিয়ানমার সরকারের সাথে কূটনৈতিকভাবে সংযুক্ত আছি। মিয়ানমারে কোন সরকার থাকবে সেটি নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই। আমরা সে দেশের সরকারের সাথে কাজ করতে চাই।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।