দ্রুত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা নিশ্চিত না হলে পরিস্থিতির ‘নাটকীয়’ অবনতি হতে পারে
2017.09.25
ঢাকা

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি হুশিয়ার করে বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য অতি দ্রুত ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা নিশ্চিত না করলে শরণার্থী শিবিরে পরিস্থিতির ‘নাটকীয়’ অবনতি হতে পারে।
গত শনি ও রবিবার কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করা উদ্বাস্তদের অবস্থা দেখে সোমবার ঢাকায় ফিরে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। তাঁর মতে, রোহিঙ্গা সমস্যা ও এর সমাধান দুই–ই মিয়ানমারের হাতে।
এদিকে বাংলাদেশ আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্যসহ ৯০০ টন ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশ্যে সোমবার রওয়ানা দিয়েছে একটি ত্রাণবাহী জাহাজ।
সংবাদ সম্মেলনে ইউএনএইচসিআর হাইকমিশনার রাখাইন রাজ্যে অনতিবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করে রোহিঙ্গাসহ সকল জাতিগোষ্ঠীর জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে মানবিক সাহায্য প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মীদের সেখানে প্রবেশ নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
“সেখানকার অবস্থা নাজুক এবং ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা দ্রুত বৃদ্ধি না করলে পরিস্থিতির নাটকীয় অবনতি হতে পারে,” মনে করেন গ্রান্ডি।
“আমি যেসব মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের অনেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত। তাদের কষ্ট শেষ হয়ে যায়নি,” জানান তিনি।
তাঁর মতে, মাঠ পর্যায়ে সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জনস্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হয়নি। তাই অবস্থা এখনো স্থিতিশীল হয়নি। পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে হলে আরো অনেক কিছু দ্রুত করতে হবে বলে মত দেন তিনি।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য জাতিসংঘের উদ্বাস্ত বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি গত শনিবার বাংলাদেশে আসেন। তিনি কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন।
এই সংকট শুরুর সময়ে জাতিসংঘ প্রাথমিকভাবে ৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক সাহায্যের আবেদন জানায় জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় আমাদের আরো অনেক বেশি প্রয়োজন। আমরা প্রয়োজন নির্ধারণ করতে সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি এবং আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বলতে পারব যে, রোহিঙ্গাদের জন্য আগামী ছয় মাসে কত টাকা লাগবে,” সাংবাদিকদের বলেন গ্রান্ডি।
সরেজমিন পরদির্শনরে অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, এখনও অনেক পরিবার পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী পায়নি।
“আমি সরকার ও আমাদের সহকর্মীদের জোর দিয়ে বলছি যে, ত্রাণ কার্যক্রম সুন্দরভাবে সম্পাদন করতে হলে আমাদের মধ্যে সঠিক সমন্বয় প্রয়োজন। এর গতি বাড়াতে হবে,” পরামর্শ দেন গ্রান্ডি।
রোহিঙ্গা সমস্যা ও সমাধান মিয়ানমারের হাতে
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গে গ্রান্ডি বলেন, “এই সংকটের কারণ ও সমাধান দুই–ই মিয়ানমার সরকারের হাতে। আমি আশা রাখি মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাসহ সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।”
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ও এখানকার মানুষ যা করেছে তা অভূতপুর্ব। এমন পরস্থিতিতে অনেক দেশই তাদের সীমানা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ তার সীমানা খুলে দিয়েছে। এটা অনেক বড় ব্যাপার।
এলাকা ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, কক্সবাজার জেলায় ২৫ লাখ স্থানীয় জনগণের ওপর প্রায় আট লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ার ফলে সেখানকার স্থানীয় পরিবেশ, অর্থনীতি ও সম্পদের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে তাঁর মত হচ্ছে, শুধু রোহিঙ্গা নয়, স্থানীয় জনগণকেও সাহায্য করা প্রয়োজন।
২৫ আগস্ট থেকে গত এক মাসে চার লাখ ৩৯ হাজার রোহিঙ্গা সীমানা অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করার তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাখাইন রাজ্য থেকে সীমান্ত এলাকায় এসে এখনও অনেক মানুষ অবস্থান করছে। তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করবে কিনা—এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আসলে আমরা জানি না কত মানুষ সেখানে এখনো অবস্থান করছে। কারণ সেখানে আমাদের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত।”
গ্রান্ডি বলেন, রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেলে বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যাবে না। তারা একদিনের নিরাপত্তা দেখে সেখানে ফিরবে না।
অবিলম্বে রাখাইনে চলমান সহিংসতা বন্ধ করা এবং ত্রাণ বিতরণ করা সংস্থাগুলোর কর্মীদের সেখানে অবাধে প্রবেশাধিকার দেওয়ার অনুরোধ জানান হাইকমিশনার। তিনি মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশের চৌকিতে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানান।
রাখাইনের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের জন্য সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত আনান কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। একই সঙ্গে রাখাইন রাজ্যে কাজের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র দূর করারও পরামর্শ দেন তিনি।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান তাঁর কক্সবাজার সফরের কথা উল্লেখ করে বলেন, তিনি পালিয়ে আসা লোকজনের মুখে দারুণভাবে মন খারাপ করা সব বর্ণনা শুনেছেন। তাদের সেই বর্ণনায় শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন আর সব ধরনের ভয়ভীতির পাশাপাশি নৃশংসতা–নিষ্ঠুরতার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ত্রাণ পাঠিয়েছে ভারত
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য সোমবার ৯০০ টন ত্রাণ সামগ্রী পাঠিয়েছে ভারত। এসব সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে, টিনজাত খাবার, কাপড় ও চিকিৎসা সামগ্রী।
ভারতীয় নৌ বাহিনীর জাহাজ আইএসএস ঘড়িয়াল এইসব ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাবে বলে জানিয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনী সূত্র।
“জাহাজটি সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বন্দর ছেড়ে গেছে এবং বাংলাদেশ পৌঁছাবে ২৮ সেপ্টেম্বর। এর মধ্যে রয়েছে খাদ্যসহ সব ধরনের ত্রাণ সামগ্রী,” বেনারকে বলেন ভারতীয় নৌ বাহিনীর মুখপাত্র ক্যাপ্টেন ডি.কে শর্মা।
ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় সেনাবাহিনী
এদিকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ অধিদপ্তরের পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান শুক্রবার বেনারকে জানান, শিঘ্রই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণসহ অন্যান্য মানবিক সতায়তার কাজে যোগদান করবে।
“বৃহস্পতিবার কক্সবাজার জেলা প্রশাসন রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েনের অনুরোধ জানায়,” বেনারকে বলেন রাশিদুল হাসান।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নয়াদিল্লি থেকে রোহিত ওয়াদওয়ানি