রোহিঙ্গা শরণার্থী: মানব পাচারের ঝুঁকিতে নারী ও শিশুরা
2017.09.25
ঢাকা

গত এক মাসে বাংলাদেশে আসা সোয়া চার লাখের বেশি রোহিঙ্গার মধ্যে মানব পাচারসহ বিভিন্ন রকমের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে শরণার্থী শিশু ও নারীরা। ইউনিসেফের মতে নতুন শরণার্থীর ষাট ভাগই শিশু, যাদের অনেকেই রাখাইনে বাবা-মাকে হারিয়ে অভিভাবকহীন অবস্থায় এসেছে বাংলাদেশে।
এদিকে নতুন আসা শরণার্থীদের মধ্যে ১৫ হাজারের বেশি গর্ভবতী নারী রয়েছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
“নতুন আসা প্রতি দশজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর ছয়জনই শিশু, যাদের বাবা-মাকে হয় রাখাইনে হত্যা করা হয়েছে, না হয় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা এসেছে,” সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানায় ইউনিসেফ।
এদিকে ২৫ আগস্ট থেকে গত এক মাসে চার লাখ ২৯ হাজার রোহিঙ্গা সীমানা অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে শুক্রবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি।
গত কয়েকদিনে অনুপ্রবেশর ঢল কমলেও “অনুপ্রবেশ এখনো বন্ধ হয়নি” বলে শুক্রবার বেনারকে জানান ইউএনএইচসিআর ঢাকা অফিসের কমিউনিকেশন অফিসার জোফেস ত্রিপুরা।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরোজুল হক টুটুল বেনারকে বলেন, “গত দুয়েক দিনে অন্যান্য সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গারা আসছে না। এখন শুধু শাহ পরীর দ্বীপ দিয়েই তাঁরা আসছে। রোহিঙ্গাদের ঢল তুলনামূলকভাবে কমে গেছে।”
জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মতে, বর্তমান হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকলে বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশে নতুন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়াবে দশ লাখের কাছাকাছি।
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশে আট লক্ষ রোহিঙ্গা রয়েছেন।
ঝুঁকিতে নারী ও শিশু
অসহায় রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা যৌনকর্মী ও ক্রীতদাস হিসেবে মানব পাচারেরর শিকার হতে পারেন বলে সতর্ক করেছেন মানবাধীকার কর্মীরা।
“আমরা দেখতে পাচ্ছি অসংখ্য শিশু একা আসছে, যারা সহায়তা পাওয়ার জন্য মরিয়া,” সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেন সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ এর পরিচালক মার্ক পিয়ার্স।
তিনি বলেন, “খুবই শঙ্কার বিষয় হলো, এই শিশুরা খুবই ঝুঁকিপুর্ণ অবস্থার মধ্যে আছে। তারা শিশু পাচারসহ শোষণ, অপব্যবহার ও অন্যান্য বিপদের মধ্যে রয়েছে।"
এদিকে রোহিঙ্গা সংকটের কারণে দেশে নারী-শিশু পাচার বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবি সমিতির প্রধান সালমা আলী।
তিনি বেনারকে বলেন, “আমি নিজে শাহ পরীর দ্বীপে তিনজন রোহিঙ্গা মেয়েকে কাঁদতে দেখে প্রশ্ন করি কী হয়েছে। ওরা আমাকে জানায় তারা রাখাইন থেকে পালিয়ে আসার জন্য নৌকায় ওঠার পর দালালরা তিনজন নারীকে আলাদা করে নিয়ে চলে গেছে। এরা কি আর ফিরবে?”
তিনি বলেন, “দেখলাম একজন জনপ্রতিনিধি একজন সুন্দরী রোহিঙ্গা নারীকে ক্যাম্পের পরিবর্তে একটি বাড়িতে নিয়ে গেলেন।”
“কোনো সন্দেহ নেই যে, এইসব নারী ও শিশুদের ভারত, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশে যৌন ও শ্রমদাস হিসেবে পাচার করা হবে,” বলেন সালমা আলী
রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নেবার জন্য দুষ্কৃতকারীরা সক্রিয় রয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরোজুল হক টুটুল।
“টেকনাফের এক দালালকে একজন রোহিঙ্গা নারীকে পাচারকালে আমি হাতেনাতে ধরেছি। এ পর্যন্ত আমরা দুই'শর বেশি দালালকে গ্রেফতার করেছি। এদের সবাইকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জেল দেয়া হয়েছে,” টুটুল বলেন।
এইসব দালালরা মানব পাচারসহ বিভিন্ন রকমের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত বলেও জানান তিনি।
“মানব পাচারের জন্য টেকনাফ বরাবরই একটি ঘাঁটি ছিল। রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যে নারী ও শিশুদের পাচারকারীদের হাত থেকে রক্ষা করা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ,” বেনারকে বলেন সাবেক পুলিশ মাহপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ।
অসহায় ও ভীত রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ‘ভুল পথে নিয়ে যাওয়া’ এখন খুবই সহজ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের যাতে টেকনাফ ও উখিয়ার বাইরে কেউ নিয়ে যেতে না পারে তার জন্য বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে বলে বেনারকে জানান টুটুল।
তিনি বলেন, “টেকনাফ ও উখিয়া থেকে বের হবার সম্ভাব্য সাতটি স্থানে আমরা চেকপোস্ট বসিয়েছি। রোহিঙ্গারা যাতে টেকনাফ ও উখিয়া থেকে বের হতে না পারে তার জন্য ব্যাপকভাবে তল্লাশি চালানো হচ্ছে।”
১৫ হাজার গর্ভবতী
নতুন শরণার্থীদের মধ্যে ১৫ হাজারের বেশি নারী গর্ভবতী, যাদের স্বাস্থ্য ও প্রজনন সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার “কঠিন পরিস্থিতি’ মোকাবেলা করছে বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বালুখালির এক বস্তিতে আশ্রয় নেওয়া আরেফা বেগমের (২৮) কোলে ১ বছর চার মাসের এক মেয়ে আর গর্ভে আরো এক সন্তান।
“পাঁচদিন ধরে বাংলাদেশে এসেছি, শুধু চিড়া মুড়ি খেয়েই দিন পার করছি। রাস্তায় যে ত্রাণ দেওয়া হয় সাত মাসের অন্তঃস্বত্তা আমি শত শত মানুষ ঠেলে তা আনতে পারি না,” বেনারকে বলেন আরেফা।
এভাবেই আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে এখনো তীব্র খাদ্য সংকট। বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী মায়েরা সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্থায় রয়েছে। এছাড়া চিকিৎসা, খাবার পানি, স্যানিটেশন সমস্যাও প্রকট।
“চার দিন ধরে কোনো খাবার খেতে পারিনি। খাবারের জন্য এখন টেকনাফ বাস স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি,”
গত সপ্তায় বেনারকে জানায় মিয়ানমারের গজবিল থেকে আসা ৯ বছরের মো. সেলিম।
“শরণার্থীদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। নারীদের মধ্যে অন্তত ১৫ হাজার গর্ভবর্তী। সরকারের জন্য একসাথে হাজার হাজার নারীর স্বাস্থ্য ও প্রসূতি সেবার ব্যবস্থা করা খুব কঠিন,” শুক্রবার বেনারকে বলেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
তবে নারীদের স্বাস্থ্য ও প্রজনন সেবা দেওয়ার জন্য সরকার দক্ষ দাই ও মেডিক্যাল টিম নিয়োগ করেছে বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা রোহিঙ্গা নারীদের স্বাস্থ্য সেবায় কাজ করছে।
“স্যানিটেশন ও পানীয় জলের সমস্যাও সেখানে রয়েছে। আশা করি এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে,” বেনারকে বলেন প্রতিমন্ত্রী জাহিদ।
তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি।