কিছুদিন স্তিমিত হয়ে আবারও বেড়েছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ

কামরান রেজা চৌধুরী ও আবদুর রহমান
2017.09.26
ঢাকা ও কক্সবাজার
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় রাখতে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী নতুন আসা রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় রাখতে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী, শাহপরীর দ্বীপ, টেকনাফ। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

গত এক সপ্তাহ ধরে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রায় বন্ধ থাকলেও গতকাল থেকে আবারও বাংলাদেশে আসা শুরু করেছে রোহিঙ্গারা। রাখাইন রাজ্যের আরও কিছু এলাকায় সহিংসতা ছড়িয়ে যাওয়ায় তারা পালিয়ে আসছেন বলে জানা গেছে।

বিজিবির টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “সাত দিন আগে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে গত রাতে (সোমবার রাতে), আমরা টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্ট দিয়ে আবারও কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ দেখেছি। যদিও সংখ্যা অনেক বেশি নয়।”

“সোমবার রাতে আট হাজার রোহিঙ্গা শাহপরীর দ্বীপ, লম্বা বেল, জালিয়াপাড়া পয়েন্ট দিয়ে টেকনাফ এবং উখিয়াতে প্রবেশ করেছে,” বেনারকে জানান টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর হোসেন।

এবার আসছে মংডু’র বাসিন্দারা

গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের পুলিশ চেক পোস্টে হামলার অভিযোগে মিয়ানমার সেনাবাহিনী জাতিগত নিধন শুরু করার পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে মংডুর বাসিন্দা কম ছিলেন। তবে গতকাল আসা শরণার্থীদের প্রায় সবাই মংডুর অধিবাসী।

“সহিংসতা বন্ধ হওয়ার আশায় গ্রামেই ছিলাম। তবে শনিবার মিলিটারি এবং মগ আমাদের গ্রামে হামলা করে। আমি, আমার স্ত্রী ও তিন বাচ্চা পালিয়ে আসলেও আমার ১০৩ বছর বয়সী বাবা (মাহমুদ হোসেন) পালাতে পারেননি। পরে জানতে পেরেছি তারা আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে,” বেনারকে বলেন মংডুর দক্ষিণ আংদ্যাং গ্রাম থেকে আসা মোঃ হাবিবুল্লাহ।

সোমবার রাতে বাংলাদেশে আসা হাবিবুল্লা বলেন, “আমি জানি না আমার এক মেয়ে আর দুই ছেলে কোথায়।”

রাখাইনে মংডুর অবস্থান বাংলাদেশের টেকনাফের ঠিক উল্টো দিকেই। শরণার্থীরা নাফ নদী পেরিয়ে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে সাবরাং এর হাঁড়িয়া খালিতে আসছেন।

“আমরা বাংলাদেশে আসতে চাইনি। আশা করেছিলাম সেখানে সহিংসতা ও নির্যাতন শীঘ্রই শেষ হবে। এজন্য গ্রামের কাছাকাছি একটি জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে ছিলাম। কিন্তু মিলিটারি ও মগ নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে,” বেনারকে বলেন মরিয়ম বেগম (৪৫)।

মংডুর হাসুরতা গ্রামের মরিয়ম দুই মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে সোমবার রাতে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্টে দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।

তিনি বলেন, “প্রতিদিন সকালে রোহিঙ্গা গ্রামের উপর দিয়ে হেলিকপ্টার টহলে এসে পেট্রোল ঢেলে দেয়। মগেরা সেসব গ্রামের চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।”

“আগে সাধারণত মেয়েদের ধর্ষণের পর তারা ছেড়ে দিত। কিন্তু এখন ধর্ষণের পর মেরে ফেলে,” জানান মরিয়ম।

চার লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ

গত ২৫ আগস্টের পর রাখাইনে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত প্রায় চার লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর জোট ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)।

আগেই ঢুকে পড়া ৩৫ হাজার রোহিঙ্গার সংখ্যা যোগ করে তালিকা হালনাগাদ করায় এই সংখ্যা বেড়েছে বলে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানায় তারা।

এদিকে সীমান্ত অতিক্রম করা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আবারও বাড়তে শুরু করেছে বলে জানানো হয়।

‘মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী’

রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধ চালাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

মঙ্গলবার দেওয়া বিবৃতিতে সংস্থাটির আইন ও নীতি বিষয়ক পরিচালক জেমস রোস বলেন, “বার্মিজ সেনারা রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের নৃশংসভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছে। এভাবে গ্রামের পর গ্রামে তাণ্ডব চালিয়ে বাড়ি ঘরে আগুন দিয়ে লোকজনকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা, সবই মানবতাবিরোধী অপরাধ।”

“জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং সংশ্লিষ্ট দেশের উচিত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে আরো কঠোর নিষেধাজ্ঞা এবং অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা,” বিবৃতিতে জানায় এইচআরডব্লিউ।

ভিন্ন কোনো দেশে এই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার সুপারিশও করেছে সংস্থাটি।

এর আগে স্যাটেলাইটে ধারণকৃত ছবি পর্যালোচনা করে এইচআরডব্লিউ বলছে, রাখাইনের অন্তত এক শ কিলোমিটার এলাকায় জ্বালাও-পোড়াও’য়ের আলামত পাওয়া গেছে। এছাড়া ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে জ্বালাও পোড়াও করেছিল তা ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক বৃহস্পতিবার

মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান সহিংসতা নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদ আগামী বৃহস্পতিবার জরুরি বৈঠকে বসছে। কূটনীতিকদের বরাতে এ খবর জানিয়েছে এএফপিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যগুলো। সেখানে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলবেন বলে উল্লেখ করা হয়।

জানা যায়, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য চার সদস্য রাষ্ট্রের অনুরোধে এ বৈঠক আহবান করা হয়েছে।

এর আগে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর মিয়ানমারে সহিংসতা দ্রুত বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিল নিরাপত্তা পরিষদ।

অনাথ রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য স্মার্ট কার্ড, আলাদা জায়গা

মিয়ানমার থেকে আসা পরিবার-বিচ্ছিন্ন ও অনাথ রোহিঙ্গা শিশুদের আলাদা ক্যাম্পে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ। তাদের শনাক্ত করে স্মার্ট কার্ড দেওয়ার কাজও চলছে।

মঙ্গলবার সচিবালয়ে সমাজকল্যাণ সচিব জিল্লার রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, “ইতিমধ্যে এক হাজার ৮০০ রোহিঙ্গা শিশুকে শনাক্ত করে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়েছে। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকল পরিবার-বিচ্ছিন্ন ও এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের এই স্মার্ট কার্ড দেওয়া হবে।”

শূন্য থেকে সাত বছরের শিশুদের এক স্থানে এবং ৮ থেকে ১৮ বছরের শিশুদের আরেক জায়গায় রেখে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে তাদের পরিচর্যা করার পরিকল্পনার কথাও জানান জিল্লার রহমান।

মানবিক সহায়তা দ্বিগুন করার দাবি

মিয়ানমার পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অবস্থা আরো শোচনীয় হতে পারে আশঙ্কা করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা দ্বিগুণ করার আহ্বান জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর।

মঙ্গলবার সংস্থাটির মুখপাত্র এ্যাড্রিয়ান এডওয়ার্ড জেনেভায় ব্রিফিংকালে এ আহবান জানান।

এদিন ইউএনএইসিআর রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশে চতুর্থ দফা ত্রাণবাহী বিমান পাঠিয়েছে বলেও জানানো হয়।

এতে বলা হয়, সংস্থাটি বাবা-মা হারানো নিঃসঙ্গ শিশু, নারী, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের মতো মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকা শরণার্থীদের শনাক্ত ও সহায়তা করার কাজ করে যাচ্ছে। এদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে আশ্রয়, খাবার, পানি ও স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।